বরগুনায় হয়ে গেল জোছনা উৎসব

ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বরগুনায় অনুষ্ঠিত হলো জোছনা উৎসব। জেলার পর্যটন শিল্পের বিকাশের লক্ষ্যে এ উৎসবের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন।
গতকাল শুক্রবার জেলার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ‘শুভ সন্ধ্যার’ বেলাভূমিতে চতুর্থবারের মতো উদযাপিত হয় এ জোছনা উৎসব।
খরস্রোতা পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর মোহনায় শুভ সন্ধ্যার বেলাভূমির একদিকে সীমাহীন সাগর, অপরদিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। নদ-নদী, বন-বনানীর অপরূপ সমাহার এ বেলাভূমিতে জোছনাস্নাত হতে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের হাজারও পর্যটক।
গতকাল দুপুর ২টায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বরগুনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতৃবৃন্দ এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
উদ্বোধনী বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বলেন, বরগুনা হলো এমন একটি জেলা যেখান থেকে নৌপথে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের দূরত্ব পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার। এ ছাড়া বরগুনায় নয়নাভিরাম স্নিগ্ধ বনভূমি আশারচর, লালদিয়ারচর, হরিণঘাটার বন, টেংড়াগিরি ও শুভ সন্ধ্যার বেলাভূমিসহ অনেক আকর্ষণীয় স্থান। এ জেলার বনাঞ্চলে রয়েছে হরিণ, বানর, শুকরসহ শতেক প্রজাতির প্রাণী। এসব আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা গেলে পর্যটন শিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
বরগুনার মানুষকে উৎসবপ্রিয় অভিহিত করে কবীর মাহমুদ আরো বলেন, জোছনা উৎসবের মতো একটি উৎসবকে দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে প্রচার করা গেলে প্রতিবছর এ উৎসবকে ঘিরেই অনেক মানুষের সমাগম হবে। আর এভাবেই এগিয়ে যাবে বরগুনা। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
উদ্বোধনী বক্তব্য শেষে বরগুনা লঞ্চঘাট থেকে দুটি দ্বিতল লঞ্চে মূল উৎসবস্থলের দিকে যাত্রা করেন কয়েক হাজার মানুষ। খাগদন নদ হয়ে বাইনচটকী বনভূমির পাশ দিয়ে কুমিরমারা ও গোড়াপদ্মার কোল ঘেষে বিকেল ৫টার দিকে লঞ্চ পৌঁছায় শুভ সন্ধ্যার বেলাভূমিতে। এর আগেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারও পর্যটক এসে ভিড় জমান উৎসবস্থলে।
এরপর দলীয় নৃত্যের মধ্য দিয়ে উৎসবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়। রাতভর চলতে থাকে জোছনার গান, রাখাইন নৃত্য, বাউল সংগীত, বাঁশি, পুঁথি, কবিতা আবৃত্তি ও ফানুস ওড়ানো। শেষ রাতে দীপালি ভাসানোর মধ্য দিয়ে এবারের মতো সমাপ্তি টানা হয় জোছনা উৎসবের।
এ উৎসব আয়োজনের পেছনে কী ধরনের ভাবনা কাজ করেছে জানতে চাইলে উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা সোহেল হাফিজ বলেন, ‘শহুরে সভ্যতায় আমরা অনেক কিছু পেলেও, হারানোর তালিকাও কম নয়। নাগরিক ব্যস্ততায় আমরা হারিয়েছি শ্রাবণের জলে সর্বাঙ্গ ভেজানোর সুযোগ, শরতের শিশিরে নগ্ন পায়ে হাঁটার অবসর, রুপালি নদীতে হৈমন্তী পূর্ণিমায় জলজোছনায় অবগাহনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। সেই সব হারানো সময় আর অনুভূতির কথা ভেবেই বরগুনায় শুভ সূচনা হয়েছিল জোছনা উৎসবের।’
জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুনীর জামান জানান, ২০১৫ সালে তরুণ লেখক ও সাংবাদিক সোহেল হাফিজের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো এ উৎসব আয়োজিত হয়। এবারই প্রথম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এটি অনুষ্ঠিত হয়। জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদের পরিকল্পনায় এবারের উৎসবে বেশ কিছু নতুন ইভেন্টও সংযোজন করা হয়। পাশাপাশি এ উৎসবকে সারা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে নেওয়া হয় বেশ কিছু পদক্ষেপ।
বরগুনা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মনোয়ার বলেন, শুরুতে এ উৎসব কেবল জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সর্বস্তরের মানুষ। দলমত নির্বিশেষে এ উৎসব এখন সার্বজনীন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
বরগুনার মানুষ উৎসবপ্রিয় উল্লেখ করে বরগুনা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বরগুনা জেলার সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান বলেন, এ জেলায় বৈশাখী মেলা থেকে শুরু করে নবান্ন উৎসব, বসন্ত উৎসবসহ আরো অনেক উৎসব আয়োজিত হয়। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জোছনা উৎসব।