৩৩ বছরেও বিজয় সরকারের সংগ্রহশালা নিয়ে কেউ কথা রাখেনি

একুশে পদক পাওয়া চারণকবি বিজয় সরকারের মৃত্যুর ৩৩ বছর পরও সংরক্ষণ করা হয়নি তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। নির্মিত হয়নি স্মৃতি সংগ্রহশালা ও গানের একাডেমি।
স্বরলিপির অভাবে এ প্রজন্মের শিল্পীরা বিজয় সরকারের গানের চর্চা ঠিকমতো করতে পারছেন না। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা কাঁচা থাকায় কবির বাড়িতে যেতে দর্শনার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
১০ বছর আগে ছোট পরিসরে ‘বিজয় মঞ্চ’ নির্মিত হলেও বেশির ভাগ জায়গা ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। ভেতরে পোকামাকড়ের মলসহ নোংরা পরিবেশ বিরাজ করছে।
কবিয়াল বিজয় সরকারের বসতভিটা নড়াইলের নিভৃতপল্লী ডুমদি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে এমন অবহেলা ও দুর্দশার চিত্র দেখা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে জেলা পরিষদের অর্থায়নে সাত লাখ টাকা ব্যয়ে নড়াইল সদরের ডুমদি গ্রামে বিজয় মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। পাঁচ বছর আগে বিজয় মঞ্চের টাইলস, জানালা, পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরলেও তা সংস্কার হয়নি। দেখার কেউ না থাকায় দিন দিন নষ্ট হচ্ছে বিজয় মঞ্চ, কবির ব্যবহৃত খাটসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। দেড় বছর আগে ডুমদি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছালেও কবির বাড়িতে নেই সুপেয় পানি ও টয়লেট ব্যবস্থা।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কুচিয়াবাড়ি গ্রামের ইয়াসিন শেখ ও তরিকুল ইসলাম বলেন, দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা বিজয় সরকারের বাড়ি দেখতে আসেন। কিন্তু এখানে রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। গ্রাম্য রাস্তায় যাতায়াতে খুব কষ্ট হয়।
নড়াইল শহরের মনিকা একাডেমির পরিচালক চিত্র ও কণ্ঠশিল্পী সবুজ সুলতান বলেন, ‘অবহেলিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে বিজয় সরকারের বসতভিটা। পর্যটকরা এসে হতাশ হন। কবির ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র এখনো সংরক্ষণ হয়নি। স্বরলিপি না থাকায় যে যার মতো বিজয়গীতি গেয়ে যাচ্ছেন। এতে অনেক সময় তাঁর গান বিকৃত হয়ে যাচ্ছে।’
উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রিনা আক্তার বলেন, ডুমদি গ্রামে কবির বাড়িতে এসে তাঁর সম্পর্কে জানার মতো কোনো উপাদান ও পরিবেশ নেই এখানে। কোনো টিউবওয়েল, বাথরুম ও বসার ব্যবস্থাও নেই।
বিজয় সরকার জন্মজয়ন্তী উদযাপন পর্ষদ প্রচার কমিটির আহ্বায়ক নড়াইল প্রেসক্লাবের সহসভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, নড়াইলের আনাচে-কানাচে তথা দেশ-বিদেশে বিজয় সরকারের গানের ব্যাপক সমাদর থাকলেও তাঁর বসতভিটা অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। কবির মৃত্যুর ৩৩ বছরেও ডুমদি গ্রামে ‘বিজয় সরকার স্মৃতি সংগ্রহশালা ও গান একাডেমি’ নির্মাণের দাবি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
চিত্রশিল্পী বলদেব অধিকারী বলেন, বিজয় সরকারের গান অবলম্বনে ৫০টি ছবি এঁকেছি। তাঁর সুরের মূর্ছনা রংতুলির মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে বিজয় সরকারের স্মৃতি সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, বিজয় সরকারের বসতভিটা রক্ষণাবেক্ষণসহ তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিজয় সরকারের বাড়িতে যাতায়াতের রাস্তাটিও পাকাকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু উন্নয়নকাজ শুরু হয়েছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুরস্রষ্টা কবিয়াল বিজয় সরকার ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদরের নিভৃতপল্লী ডুমদি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের হাওড়ার বেলুড়ে পরলোকগমন করেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কেউটিয়ায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন বিজয় সরকার। এক হাজার ৮০০-এর বেশি গান লিখেছেন তিনি। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৩ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন তিনি। তাঁর প্রকৃত নাম বিজয় অধিকারী হলেও সুর, সংগীত ও অসাধারণ গায়কী ঢঙের জন্য ‘‘সরকার’’ উপাধি লাভ করেন।
গানের কথা ও সুরের মাঝে বিজয় সরকার আজো বেঁচে আছেন হাজারো মানুষের হৃদয়ে।