আটকের দুই সপ্তাহ পর হাতে হাতকড়ায় সেই মান্নান তালুকদার

খুলনা বাগেরহাটের সেই বহুল আলোচিত উমেদার থেকে জমিদার হয়ে ওঠা আব্দুল মান্নান তালুকদারকে অবশেষে পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে আদালতে উপস্থাপন করেছে। দুই সপ্তাহ আগে দুদকের অর্থ আত্মসাতের মামলায় বাগেরহাট আদালতে জামিন নিতে এলে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। সে সময় তিনি নিজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে আদালত থেকে কারাগারে যান। তখন হাতে ছিল না হাতকড়া, নিজের লোকজনে চারপাশ বেষ্টিত ছিলেন। গণমাধ্যমকর্মীরা ছবি তুলতে চাইলে তাতেও বাধা সৃষ্টি করা হয়।
এদিকে রংপুর আদালতে ২১ কোটি টাকার চেক প্রতারণার মামলায় মান্নান তালুকদারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আগামী ৫ আগস্ট মান্নান তালুকদারকে রংপুর আদালতে উপস্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
খুলনার সোনাডাঙ্গা থানায় মান্নান তালুকদারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন হালিমা বেগম নামের এক নারী। এ মামলায় গতকাল রোববার খুলনার আদালতে তোলা হয় মান্নান তালুকদারকে।
বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, সাতক্ষীরা ও নড়াইলসহ খুলনা বিভাগে বিভিন্ন স্থানে নিউ বসুন্ধধারা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের নামে অর্থ দ্বিগুণ করার প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছিলেন আব্দুল মান্নান তালুকদার। তিনি নিজে এনটিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক, পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও দুর্নীতি দমন কমিশন।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তদন্তে শুধু বাগেরহাট জেলায় প্রতারণার মাধ্যমে আড়াইশ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে জানিয়ে নিউ বসুন্ধরার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। একই সময় দুর্নীতি দমন কমিশন খুলনা তদন্ত শুরু করে শুধু বাগেরহাট জেলায় ব্যাংকিং চ্যানেলে ১১০ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায়। এ সময় দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শাওন মিয়া বাদী হয়ে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মান্নান তালুকদার এবং চেয়ারম্যানকে আসামি করে ১১০ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করে।
এ মামলায় গত ১৫ জুলাই মান্নান তালুকদার বাগেরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে জেলহাজতে পাঠান। এ সময় মান্নান তালুকদার প্রিজন ভ্যানে না উঠে নিজের এসি গাড়িতে করে তার ছবি তোলার সুযোগ না দিয়ে জেলা কারাগারে যান। ঘটনার পরের দিন পত্রপত্রিকায় প্রকাশের পর বাগেরহাট পুলিশ সুপার আদালতে কর্তব্যরত পাঁচ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করেন।
গতকাল রোববার দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শাওন মিয়া মামলা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতি প্রার্থনা করেন। তবে এদিন নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের এমডি আব্দুল মান্নান তালুকদারকে অন্য এক ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে হাতকড়া পরিয়ে প্রিজন ভ্যানে আদালতে আনা এবং নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শাওনা মিয়া জানান, আদালত তাদের আবেদন অনুযায়ী জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন। তবে প্রয়োজন হলে তাঁকে আবার রিমান্ডে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অ্যাজাক্স জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার জামান বাবলা জানান, গত ২৫ জুলাই রংপুর সেশন জজ আদালতের সাড়ে ২১ কোটি টাকা চেক প্রতারণার তিনটি মামলায় আব্দুল মান্নান তালুকদারকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। আগামী ৫ আগস্ট মান্নান তালুকদারকে রংপুর আদালতে উপস্থাপন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, জুট মিল ক্রয় চুক্তি হিসেবে সাড়ে ২১ কোটি টাকার চেক দিয়েছিলেন মান্নান তালুকদার। কিন্তু চেকগুলোর বিপরীতে ওই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা না থাকায় তিনি মামলা করেন।
এদিকে খুলনা সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মমতাজুল হক জানান, বড় বয়রা আন্দিরঘাট এলাকার হালিমা বেগম বাদী হয়ে নিউ বসুন্ধরার এমডি, চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপকের নামে বিশ্বাস ভঙ্গ করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং হুমকির অভিযোগ এনে ২৪ জুলাই রাতে মামলা করেন।
মামলার আর্জিতে বলা হয়, তিনি নিউ বসুন্ধধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডে চার লাখ ৫০ হাজার টাকা জামানত রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ বছরের ১৩ মে তার টাকা ফেরত আনতে গেলে তাঁকে টাকা ফেরত না দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি এ মামলা করেন। মামলায় এমডি মান্নান তালুকদার, চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান, খুলনার ব্যবস্থাপক মহিউস ওরফে বুলবুলকে আসামি করা হয়েছে । মামলাটি তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক (এসআই) তৌহিদুর রহমান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের এমডি আব্দুল মান্নান তালুকদার ও তাঁর বেশির ভাগ গ্রাহক চরমোনাই পীরের মুরিদ ও অনুসারী। চরমোনাই পীরের রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের খুলনার শীর্ষস্থানীয় নেতা রজব আলী ইঞ্জিনিয়ার, মাওলানা আব্দুল আওয়াল, মাওলানা মুজাম্মিল হক, মুফতি মাওলানা ওয়াক্কাসদের কথামত পীরের অনুসারীরা এখানে টাকা আমানত রাখেন। ধর্মভীরু মানুষকে অতিরিক্ত অর্থের প্রলোভনসহ হালাল আয়ের কথা বলে এই বিপুল অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ঘটনায় চরমোনাই পীর মাওলানা রেজাউল করিম নিজেও অনেকটা বিব্রত বলে জানা গেছে। পীর সাহেবের নির্দেশে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের সঙ্গে জড়িতদের ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন।
এর মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হাতপাখা মার্কার মেয়র প্রার্থী এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাওলানা মুজাম্মিল হককে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের বোর্ড চেয়ারম্যান মুফতি মাওলানা ওয়াক্কাসকে দলীয় পদ এবং গোয়ালখালী প্রি ক্যাডেট মাদ্রাসার চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আওয়ালকেও দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে ইসলামী আন্দোলনের সাবেক নেতা মাওলানা মুজাম্মিল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এমন হবে জানলে তিনি গ্রাহকদের টাকা আমানত রাখতে বলতেন না।
মাওলানা মুজাম্মিল হক স্বীকার করেন, তিনি নিজেও বহু টাকা নিউ বসুন্ধধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি তাঁদের বিপদের সময় তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।