এতিমখানায় এতিম নেই, বরাদ্দ আছে!

এতিম নেই, তবুও বরাদ্দ পাচ্ছে কিছু এতিমখানা। নড়াইলে বছরের পর বছর এতিমদের নামে সরকারি টাকা এভাবে লুট করে নেওয়ার অভিযোগ অনেক।
তবে এসব নিয়ে অভিযোগ করে কোনো লাভ হয়নি। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন এতিমের টাকা লুট হলেও যেন দেখার কেউ নেই। বার্তা সংস্থা ইউএনবির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
ইউএনবির প্রতিবেদনে বলা হয়, সদরের চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই এতিমখানা। ১৯৮৫ সালে বেসরকারি সংস্থা কারিতাসের সহায়তা পাওয়া এই এতিমখানায় জেলা পরিষদ থেকেও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে।
১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরে এতিমখানাটি সমাজসেবার মাধ্যমে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত হয়। কয়েক দফা সরেজমিন পরিদর্শন করে এতিমখানার নানা অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ে। বেশিরভাগ সময় এতিমখানাটি বন্ধ থাকে। এখানে দুটি বড় টিনশেড ভবন থাকলেও সেখানে এতিমদের থাকার কোনো পরিবেশ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং ১১৪ এতিমের নামে মাসে এক লাখ ১৪ হাজার টাকা আর বার্ষিক ১৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা বরাদ্দ পায়। অথচ এতিমখানায় প্রকৃত এতিমদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। চার থেকে পাঁচজন থাকলেও তারা নিজেদের অর্থে থাকে ও খায়।
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘এই লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে পাশের মাদ্রাসার কিছু ছাত্র রোজার সময় থেকে নামাজ পড়ে, নিজেদের টাকায় খায়, আবার বাড়িতে চলে যায়।’
এর পাশেই অবস্থিত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের নিজের নামে নির্মিত জেলার সবচেয়ে বড় বালিকা এতিমখানা ‘আজিজুর রহমান ভূঁইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানা’। এই এতিমখানার সুপার কাজী আবদুল কাদের। ১২৭ বালিকা এতিমের জন্য এখানকার বার্ষিক বরাদ্দ ১৫ লাখ ২৪ হাজার। এই এতিমখানার অবস্থা প্রায় একই রকম।
সরেজমিনে গিয়ে সেখানে ১৪ শিশুর দেখা মিলেছে। শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশপাশের বিভিন্ন মেয়ে এখানে থাকে আর মাদ্রাসায় পড়ে। বড়জোর ৪০ এতিমের তথ্য দিতে পেরেছে এসব শিশু। তবে ৪০ এতিম মেয়ে থাকলেও তার মধ্যে শুধু দুজন প্রকৃত এতিমের সন্ধান পাওয়া গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আজিজুর রহমান ভূঁইয়া বালিকা সমাজসেবা এতিমখানার সভাপতি ও সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের সহসভাপতি চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভূঁইয়া। চেয়ারম্যানের প্রভাব খাটিয়ে ওই দুই এতিমখানার সুপারসহ অন্যরা বছরের পর বছর এতিমের টাকা লুটেপুটে খাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজনের অভিযোগ, এতিমখানার টাকায় গড়ে ওঠা ছাগলের খামারের দেখাশোনা করে এতিম মেয়েরা। এতিমখানার সুপার কাজী আবদুল কাদের ও তাঁর স্বজনদের বাড়িতে এতিমদের কাজ করানো হয়, তাঁদের নিজেদের কাজে পাঁচ এতিম শিশুকে ব্যবহার করা হয়।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সমাজসেবার তত্ত্বাবধানে তিন উপজেলার মোট এতিমখানার সংখ্যা ৪৩টি। ছোট-বড় এসব এতিমখানায় মোট এক হাজার ২৬৪ জন এতিমের জন্য মাসে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয় ১২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা আর বার্ষিক দেওয়া হয় দেড় কোটি টাকা।
ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট পাওয়ার শর্ত অনুযায়ী, প্রত্যেক এতিমখানা নিজস্ব অর্থে যে কয়েকজন এতিম পালন করে, তার দ্বিগুণ এতিম থাকলেই কেবল অর্ধেকের জন্য অনুদান পাওয়া যাবে।
সীমানন্দপুর গরীবশাহ এতিমখানার সুপার কাজী রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যেসব অনিয়ম আছে, সব ঠিক করা হবে। এরপর আসলে সব ঠিকঠাক দেখতে পাবেন।’
ভূঁইয়া আজিজুর রহমান বালিকা এতিমখানার সুপার কাজী আবদুল কাদের বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী আমাদের এতিমখানা চলছে।’ তবে বাড়িতে শিশুদের কাজ করানোর বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
এতিমখানা প্রসঙ্গে চণ্ডীবরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘এগুলো সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এতিমখানা দুটি সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না স্বীকার করে নড়াইলের জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা বলেন, ‘আমার আগের কথা বলতে পারব না। তবে আমি নির্দেশনা দিয়েছি, ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট পেতে গেলে প্রকৃতপক্ষে যে কজন এতিম আছে, তাদের হিসাব করেই দিতে হবে।’