রামু সহিংসতার ৭ বছর : সাক্ষীর অভাবে মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

রামুর বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সাত বছর চলে গেছে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে রামুর বৌদ্ধবিহার ও বসতিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার মধ্য দিয়ে রামুর মুসলমান, বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির বন্ধনে আঘাত করে দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বৌদ্ধদের পুরোনো ১২টি বিহার ও ৩২টি বসতবাড়ি। ভাঙচুর করা হয় আরো ছয়টি বৌদ্ধবিহারসহ শতাধিক বসতঘর।
সরকারি নানা উদ্যোগ ও সুশীল সমাজের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সম্প্রীতি ফিরে আসতে শুরু করেছে। পোড়া মন্দিরে তৈরি হয়েছে নান্দনিক স্থাপনা। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাশৈলীতে পুণ্যার্থীদের পাশাপাশি বাড়ছে পর্যটকের আনাগোনা। তবে বিচারকার্য ও মামলার বিষয় নিয়ে শঙ্কিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়।
সাত বছরে ১৮টি মামলার একটিও বিচারকাজ শেষ হয়নি; বরং উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে উল্টো মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বৌদ্ধবিহার ও বসতঘরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। পরদিন বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরো চারটি বৌদ্ধবিহারে হামলা চালানো হয়।
এ ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুটি। বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনায় করা ১৯ মামলার এজাহারে নাম-ঠিকানা উল্লেখিত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। রামু থানার আট মামলার এজাহারে মোট আসামি সাত হাজার ৮৭৫ জন। এর মধ্যে ১১১ জনের নাম-ঠিকানা থাকলেও পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পেরেছিল মাত্র ৭৪ জনকে। আর সন্দেহভাজনদের মধ্যে আটক করেছিল ১৩২ জনকে। উখিয়া থানার সাত মামলায় পাঁচ হাজার ৬২৪ আসামি থাকলেও গ্রেপ্তার ছিল ১১৬ জন। টেকনাফ থানার দুটি মামলায় ৬৫৩ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার ছিল ৬৩ জন। কক্সবাজার সদর মডেল থানায় দুই মামলায় এক হাজার ৩০ আসামি থাকলেও গ্রেপ্তার ছিল ৯৮ জন। গত সাত বছরে ধাপে ধাপে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গেছে সবাই।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার পর আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি জড়িতদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে সুপারিশ করে। কিন্তু ঘটনার পরিকল্পনাকারী গডফাদারদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করে এসব মামলা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। আবার অনেক সাক্ষীর নাম-ঠিকানাও লেখা হয় ভুলভাবে। তাই আটক সবাই পেয়ে গেছে জামিন। দায়ীরা রয়েছে এখনো অধরা।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুপক্ষের আপস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত।
বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। এর মধ্যে রামুর উখিয়ারঘোনা জেতবন বৌদ্ধবিহার, লট উখিয়ারঘোনা জাদীপাড়া আর্য্যবংশ বৌদ্ধবিহার ও ফতেখাঁরকুলের লালচিং, সাদাচিং ও মৈত্রী বিহার এবং চাকমারকুল ইউনিয়নের অজান্তা বৌদ্ধবিহার এবং উখিয়ার একটি মামলা আদালত থেকে অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে দেওয়া হয়। পিবিআই অধিকতর তদন্ত শেষে এসব মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেছে বলে জানা যায়।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সরকারপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলায় সাক্ষী বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। তাঁরা ভয়ে কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। তিনি বলেন, বেশিরভাগ সাক্ষী অনুপস্থিত থাকায় এসব মামলার বিচার বিলম্বিত হচ্ছে।
রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক রজত বড়ুয়া রিকু বলেন, ১৮টি মামলার বাদীই পুলিশ। পুলিশ কাকে আসামি করেছে, কাকে বাদ দিয়েছে কিছুই বৌদ্ধ সম্প্রপ্রদায় জানে না। এমনকি যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগপত্রে নেই। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পুলিশকে বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত অপরাধীদের অনেকের অভিযোগপত্রে নাম আনা হয়নি। এ অবস্থায় বর্তমানে ভয়ে সাক্ষীরাও সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।
রজত বড়ুয়া আরো বলেন, ঘটনার পর থেকে সরকার এবং সেনাবাহিনীর কাছ থেকে অনেক সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন বৌদ্ধবিহার ও বাড়িঘর নির্মাণসহ পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে সরকারের প্রতি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। বর্তমানেও সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহযোগিতা অব্যাহত থাকলেও প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই আইনের আওতায় না আসায় ঘটনায় দায়ীদের বিচার আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে।
কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, এ ঘটনায় রামুর হাজার বছরের গর্বের ধন ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে’ যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছিল, তা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। সাক্ষীর কারণে মামলা দীর্ঘসূত্রতার দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আইনজীবী ও আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে মামলা তদারকিতে টিম গঠন করলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার কাজ পরিচালনা সহজ হতো বলে তিনি জানান।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন বলেন, বর্তমানে মামলাগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নিরাপত্তা বিষয়টি ভেবে অনেকে সাক্ষী দিতে রাজি হচ্ছেন না। সাক্ষীদের সব নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পুলিশের। যদি কোনো অভিযোগ আসে সাক্ষীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তরা হামলা চালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল পুরাকীর্তিসমৃদ্ধ রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহার। পুড়ে যায় বিহারে থাকা হাজার বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন। সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয়েছে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে তিনতলা সুরম্য ভবন।
একইভাবে সেদিন দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দিয়েছিল উত্তর মিঠাছড়ির ‘বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র’। যেখানে আগে থেকেই তৈরি করা ছিল ১০০ ফুট দীর্ঘ গৌতম বুদ্ধের সিংহশয্যা দৃষ্টিনন্দন বুদ্ধমূর্তি। সেই রাতে চেষ্টা করেও দুর্বৃত্তরা এ মূর্তিটির বড় কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।
শ্রীকুল গ্রামে একই কম্পাউন্ডে আছে মৈত্রী বিহার, লাল চিং, সাদা চিং ও অপর্ণা চরণ বৌদ্ধবিহার। সংস্কারের পর সেনাবাহিনী এ কম্পাউন্ডের নামকরণ করেছে লালচিং-মৈত্রী কমপ্লেক্স। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত চেরাংঘাটা উসাইসেন বৌদ্ধবিহার বা বড় ক্যাং, জাদীপাড়া আর্যবংশ বৌদ্ধবিহার, উখিয়ারঘোনা জেতবন বিহার, উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার, চাকমারকুল অজন্তা বৌদ্ধবিহারসহ ক্ষতিগ্রস্ত সবকটি বিহারে সেনাবাহিনী সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে তুলেছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধবিহার।
রামুতে বুদ্ধমূর্তি, বৌদ্ধবিহার ও বৌদ্ধ বসতিতে ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক হামলার সেই বিভীষিকাময় দিন স্মরণে গত বছরগুলোর মতো এ বছরও স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ। দিনব্যাপী এ স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন উপ-সংঘরাজ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের। প্রধান ধর্মদেশকের বক্তৃতা করবেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার মহাসচিব এস লোকজিৎ থের। এদিকে আজ রোববার রামু সহিংসতার সাত বছর স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ। এ উপলক্ষে লাল চিং-মৈত্রী বিহার কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে ভোরে বুদ্ধপূজা, সকালে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্ট পরিষ্কার দানসহ মহাসংঘদান, দুপুরে অতিথি ভোজন ও অবস্থান কর্মসূচি, বিকেলে হাজার প্রদীপ প্রজ্বালন ও সন্ধ্যায় আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং বিশ্ব শান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ স্থানীয় বৌদ্ধ গ্রামবাসীর অংশ নেওয়ার কথা জানান ২৯ সেপ্টেম্বর স্মরণ অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক প্রিয়রত্ন মহাথের ও সদস্য সচিব শীলমিত্র থের।