‘শুধু তোমাকেই পেতে হে পেঁয়াজ…

‘শুধু তোমাকেই পেতে হে পেঁয়াজ
মাথাভাঙ্গা রোদে ৪ ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে
শুধু তোমারই জন্য হে পেঁয়াজ।’
সচিবালয়ের পশ্চিম পাশে আর জাতীয় প্রেসক্লাবের পূর্ব পাশে রাস্তার মধ্যে এক দীর্ঘ্ লাইনে দাঁড়িয়ে এভাবে উচ্চ স্বরে একটি প্যারোডি কবিতা আবৃত্তি করছিলেন সচিবালয়ের এক কর্মচারী।
কবি শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এর আলোকে পেঁয়াজের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের রচিত কবিতা আবৃত্তি করে সবাইকে জমিয়ে রাখছিলেন তিনি।
আজ রোববার বেলা ১ টার দিকে প্রেসক্লাবের পূর্ব পাশের গেটে গিয়ে দেখা যায় শতাধিক মানুষের বিশাল লাইন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনও দীর্ঘ হয়। এক পর্যায়ে তা এঁকেবেঁকে আবদুল গণি রোডের মাথায় গিয়ে থামে। লাইনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। কেউ ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা, প্যারোডি গান ও নানা খোশগল্প করে সময় পার করার চেষ্টা করছিলেন
‘শুধু তোমাকেই পেতে হে পেঁয়াজ’ এর আবৃত্তিকারের কাছে গিয়ে তাঁর পরিচয় ও কবিতা আবৃত্তির কারণ জানতে চাইলে নিজেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘সকালেই সচিবালয়ে ঘোষণা করা হয়েছে- আজ সচিবালয়ের কর্মচারীদের জন্য টিসিবি পেঁয়াজ বিক্রি করবে। শোনার পরপরই অফিসে স্যারের কাছ থেকে বলে পেঁয়াজ কিনতে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছি।’ তাঁর মতো আরো শতাধিক কর্মচারী লাইনে। লাইনে প্রেস ক্লাবের অনেক কর্মচারীকেও দেখা গেল। তাঁরাও টিসিবির ন্যায্যমুল্যের পেঁয়াজ কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের কর্মচারী রুহুল দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইনে। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখানে দুই কেজি পেঁয়াজের দাম হলো ৯০ টাকা। বাইরে খোলা বাজারে এই দুই কেজির দাম কম করে হলেও ২৪০ টাকা। আমার ১৫০ টাকা সাশ্রয় হবে। এ জন্যই লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী রফিক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এ লাইনে এসে দাঁড়িয়েছি সকাল সাড়ে ৯ টায়। ১১ টার দিকে একবার লাইনে দাঁড়ানো আমার সামনের ও পেছনের দুইজনকে বলে অফিসে গিয়ে কিছু কাজ করে এসেছি। দুই কেজি পেঁয়াজ পেলে আমার ১৫০ টাকা বেঁচে যাবে।’
বেলা সোয়া ১ টার দিকে একটি ট্রাক এসে থামলো লাইনের মাথায়। ট্রাকটির সামনে লেখা আছে ‘টিসিবির কর্তৃক খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি।’ ট্রাকের ভেতরে চার থেকে পাঁচ বস্তা পেঁয়াজ। বস্তাগুলো ভেদ করে গাছ উঁকিঝুকি মারছে। এ পেঁয়াজ কিনতেই সকাল ৯ টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন শতশত মানুষ।’
ট্রাক থামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে হৈ চৈ ও চিৎকার চেঁচামেচি। লাইন ভেদ করে কেউ যাতে ভেতরে ঢুকে অবৈধ সুবিধা নিতে না পারেন সেই জন্যই একজন আরেকজনকে সতর্ক করে দিচ্ছেন।
ট্রাকের থাকা টিসিবির কর্মচারী লাইনে দাঁড়ানো সবাই উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়ান। একজন একবারে দুই কেজি করে পেঁয়াজ পাবেন। ৯০ টাকা ভাংতি দেবেন। আমাদের কাছে ভাংতি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের ট্রাকে পেঁয়াজ আছে ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের দেওয়া হবে। যারা আজ পাবেন না, তারা আগামীকাল আবার আসবেন।’
লাইনের দিকে তাকিয়ে টিসিবির বয়স্ক এ কর্মচারী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সবাইকে দুই কেজি করে পেঁয়াজ দিতে পারবেন কি না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দুই কেজি নয়, ১০০ গ্রাম করে দিলেও সবাইকে দেওয়া যাবে না। যতক্ষণ আমাদের কাছে থাকবে, আমরা ততক্ষণই দেব। শেষ হয়ে গেলে আমরা পাবো কই? আমরা তো আর বানাতে পারবো না।’
ট্রাকের পেঁয়াজের পরিমাণ ও লাইনের লোকসংখ্যা দেখে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। কেউ কেউ লাইন ভেঙ্গে পেছন থেকে সামনে এসে পেঁয়াজের পরিমাণ দেখে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে চলে যান।
যারা পেঁয়াজ পেয়েছেন তারা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন। রাজ্যের তৃপ্তি নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে চলে যান তারা। লাইনের পেছন থেকে চলে যাচ্ছিলেন এক কর্মচারী। চলে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘ট্রাকে যে পরিমান পেঁয়াজ আছে তাতে করে লাইনের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষও পাবে না। এমনিতেই প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। এখন আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ দেখছি না। তাঁর মতো আরো অনেককেই মন খারাপ করে চলে যেতে দেখা গেছে।’
গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত বাংলাদেশের পেঁয়াজ রপ্তানির ক্ষেত্রে এলসি মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এতে ওইদিন ৩০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজ এক লাফে ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি শুরু করে ব্যবসায়ীরা। সরকার ২৪ ঘন্টার মধ্যে পেঁয়াজের দাম স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েও ব্যর্থ হয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। এতে আরে দফা বেড়ে পেঁয়াজের কেজি হয় ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা। এখনো খোলাবাজারে একই দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ।