রাজশাহীতে কাকের মৃত্যুর কারণ ‘বার্ড ফ্লু’

রাজশাহীতে একের পর এক কাকের মৃত্যুর কারণ অতি ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রার বার্ড ফ্লু ভাইরাস। কাকের কারণে এবার মানবদেহেও বার্ড ফ্লু সংক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে এত ভয়াবহ মাত্রার এই ভাইরাসের অস্তিত্ব মেলেনি।
এ অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে রাজশাহীতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে স্বাস্থ্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত ১২ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি। গত বৃহস্পতিবার তারা কাকের আবাসস্থল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল চত্বর পরিদর্শন করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই দলের এক সদস্য জানান, এই বার্ড ফ্লুতে মানুষ সংক্রমিত হলে প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এ কারণে রামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে ১ ফেব্রুয়ারির পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত কোনো রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখেন কমিটির সদস্যরা। একইভাবে ওই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে শ্বাসকষ্ট নিয়ে কেউ ভর্তি হয়ে থাকলে তারও খোঁজখবর রাখছেন তাঁরা। বার্ড ফ্লু কোনো মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছে কমিটি।
এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক, রাজশাহীর সিভিল সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও চিকিৎসক এবং মুরগির খামারিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন দলের সদস্যরা। এ বিষয়ে ওই টিমের অন্যতম সদস্য ইনস্টিটিউট অব ইপিডেমিওলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর) চিকিৎসক ডা. ওয়ালি জানান, তাঁরা আরো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ঢাকায় ফিরে গিয়ে সমন্বয় করবেন। এরপর এ বিষয়ে ঢাকাতেই সাংবাদিকদের অবহিত করবেন।
এদিকে, রাজশাহী মহানগরে বার্ড ফ্লুতে কাকের মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে সিটি করপোরেশন (রাসিক)। রাসিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম উল আযীম বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এফ এ এম আঞ্জুমান আরা বেগম ও প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মো. মামুনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় করেছেন।
মেয়রের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বিষয়টি খতিয়ে দেখে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ রোগ যেন ছড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সচেতন থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সিভিল সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি বুধবার সমন্বয় সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি করপোরেশন।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন জানান, রাজশাহীতে বার্ড ফ্লুর অস্তিত্ব পাওয়ার পর সিটি করপোরেশন ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন বাজারে খোলা জায়গায় মুরগির উচ্ছিষ্ট ফেলা হচ্ছে। এগুলোই কাকের অন্যতম খাবার। কাজেই এ উচ্ছিষ্ট থেকে বার্ড ফ্লু ছড়াচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ জন্য খোলা জায়গায় মুরগির নাড়িভুঁড়ি না ফেলে সেগুলো সারা দিন সংরক্ষণ করে সন্ধ্যায় পুঁতে ফেলতে বলা হয়েছে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে পরপর কয়েকদিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে বিপুলসংখ্যক কাকের মরদেহ পাওয়া যায়। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে নড়েচড়ে বসে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। ইনস্টিটিউট অব ইপিডেমিওলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর), জয়পুরহাটে অবস্থিত আঞ্চলিক রোগ অনুসন্ধান কেন্দ্র এবং সেন্টার ফর কমিউনিকেবল ডিজিজের কর্মকর্তারা মৃত কাকের আলামত সংগ্রহ করেন।
মরে যাওয়া কাকের নমুনা পরীক্ষা করে সেখানে বার্ড ফ্লু রোগের জীবাণু ধরা পড়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে ফ্রান্সে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর এনিমেল হেলথের ওয়েবসাইটে।
ফ্রান্সের ওই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যের বরাত দিয়ে নগরীর বোয়ালিয়ার থানা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ইয়ামিন আলী জানান, এইচফাইভএনওয়ান (অতি ঝুঁকিপূর্ণ) ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল কাকগুলো। তবে এই ভাইরাস কাকের মধ্যে কীভাবে সংক্রমিত হলো, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। এর আগে আমাদের দেশে মুরগির মধ্যে বার্ড ফ্লুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিন্তু কাকের মধ্যে এত ব্যাপক হারে তা কখনো দেখা যায়নি। তবে কাক সাধারণ মুরগির নাড়িভুঁড়ি খেয়ে থাকে।
ইয়ামিন আলী বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, জবাই করা মুরগির উচ্ছিষ্ট থেকে কাকের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারে। কাক থেকে খামারে বা খামার থেকে যাতে কাকের মধ্যে এ ভাইরাস আর ছড়াতে না পারে, সে জন্য রাজশাহীর মুরগির বাণিজ্যিক খামারিদেরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।