বন ছেড়ে লোকালয়ে মৌমাছি, মধু নিয়ে হাহাকার

এপ্রিল মাসজুড়েই চলে সুন্দরবনে মধু আহরণের মৌসুম। কিন্তু মৌসুম শেষ হতে চললেও সুন্দরবনের যে সব এলাকা থেকে প্রতি বছর মধু আহরণ করা হতো এবার সে সব জায়গায় মৌচাক ও মৌমাছি নেই বললেই চলে। ফলে মধু ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত সুন্দরবন এবার মধুশূন্য হয়ে পড়েছে।
মাইলকে মাইল বনের পথ হেঁটে একফোটা মধুও সংগ্রহ করতে পারছে না কোনো কোনো মৌয়ালদল। মধু না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসতে হচ্ছে তাদের। মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া দাদনের টাকা কীভাবে তারা পরিশোধ করবে এই ভেবে দিশেহারা মৌয়ালরা, হতাশ দাদন দেওয়া ব্যবসায়ীরাও। একেবারেই মধুশূন্য বনের এমন চিত্র আর কোনো দিন দেখেনি এ অঞ্চলের মৌয়াল ও সাধারণ মানুষ।
পূর্ব সুন্দবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় এ অবস্থা বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। ফলে এ বছর এ অঞ্চলে মধু সংকট চরম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সুন্দরবনে মৌমাছি বা মৌচাকের দেখা না মিললেও বন সন্নিহিত গ্রামগুলোতে মৌমাছির বেশ সমাগম ঘটেছে এবার। মৌচাকও হয়েছে অসংখ্য। এমন চিত্র অন্য কোনো বছর দেখা যায়নি। বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও বাড়ির গাছগাছালিতে বাসা বেঁধেছে মৌমাছিরা।
বনবিভাগ ও মৌয়ালদের কাছ থেকে জানা যায়, মধু না পাওয়ার প্রাথমিক কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন এ বছর একেবারেই বৃষ্টি না হওয়া। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে একদিকে যেমন বনের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি সময় মতো গাছে ফুলও আসছে না। এর ফলে খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় মৌমাছিরা সুন্দরবন ছেড়ে লোকালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তর থেকে দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ চলাচল করছে। ওই সব জাহাজের হাইড্রোলিক হর্নের বিকট শব্দে বনের প্রাণিকূল সব সময় আতঙ্কে থাকে। এসব কারণেও ধীরে ধীরে মৌমাছিরা বন ছাড়ছে বলে বন বিভাগ দাবি করছে।
মধু না পেয়ে এরই মধ্যে শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার শতাধিক মৌয়াল ফিরে এসে তাদের পাস পারমিট (অনুমতি) সুন্দরবন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
ফিরে আসা এমন বেশ কয়েক জন মৌয়ালের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানিয়েছেন চরম হতাশার কথা। এঁদের মধ্যে দক্ষিণ সাউথখালী গ্রামের ইউনুছ মোল্লা, মজিদ মোল্লা, বকুলতল গ্রামের আ. গনি, তাফালবাড়ি গ্রামের মনিরুজ্জামান, চালিতাবুানয়া গ্রামের আবুল কালাম, কবির বয়াতী, বগী কাঞ্চন মোল্লা ও উত্তর সাউথখালী গ্রামের ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রতিবছর পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন টিয়ার চর, দুধমুখী, কোকিল মনি, ভেদাখালী, মেহের আলীর চর, আলোর কোল ও খাজরা এলাকার বনে মধু সংগ্রহ করতে যান। ওই সব এলাকা থেকে তাঁরা প্রতি গোনে (যাত্রা) একেকজন মৌয়াল দুই থেকে তিন মণ মধু পেতেন। কিন্তু এবার দুই কেজিও মধুও পাননি তাঁরা। মাইলের পর মাইল বনে হেঁটেও কোনো মৌচাক বা মৌমাছির দেখা মিলছে না। এসব মৌয়াল ১৫-২০ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু আহরণ করে আসছেন। কিন্তু এমন পরিস্থিতিরি সম্মুখীন হতে হয়নি কখনো তাঁদের। এখন মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তাঁরা।
মংলা শহরের মধু ব্যবসায়ী বেল্লাল হোসেন ও শরণখোলার রায়েন্দা বাজারের মধূ ব্যবসায়ী ইব্রাহীম বনি আবদুর রশিদ জানান, এ মৌসুমে মৌয়ালদের কাছ থেকে নগদ টাকায় কিনে মধুর ব্যবসা করেন। কিন্তু এ বছর এক কেজিও মধু কিনতে পারেননি। বনসংলগ্ন খুড়িয়াখালী বাজারের ব্যবসায়ী জালাল মোল্লা জানান, তিনি এবার পাঁচটি নৌকার পাস (অনুমতি) নিয়েছেন মধু আহরণের জন্য। তাতে এ পর্যন্ত মধু পেয়েছেন মাত্র তিন মণ। গত বছর এই সময়ের মধ্যে ওই পাঁচ নৌকায় পেয়েছিলেন ১৫০ মণ। গতবার যে মধুর মণ ছিল ১০ হাজার টাকা, এবার সেই মধুর মণপ্রতি ১৮ হাজার টাকা বলে জানান তিনি।
তবে লোকালয়ে অসংখ্য মৌচাক থাকলেও তাতে মধুর পরিমাণ খুবই কম এবং মধুর মানও ভালো না। লোকালয় থেকে যে মধু পাওয়া যাবে তাতে চাহিদার এক ভাগও পূরণ হবে না। ফলে মধু সংকটের কারণে মূল্য বৃদ্ধি ও ভেজাল মধুর ছড়াছড়ি হবে বলে আশঙ্কা করছেন এসব ব্যবসায়ী।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, এ বছর শরণখোলা রেঞ্জের আওয়াতাধীন শরণখোলা, বগী ও সুপতি স্টেশনে প্রথম ধাপে মধু সংগ্রহের জন্য ৪০টি নৌকার পাস (অনুমতি) হয়েছে। বন সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের তিন শতাধিক মৌয়াল বনে যান। কিন্তু মধু না পেয়ে এঁদের মধ্য থেকে শতাধিক মৌয়াল ফিরে এসে পাস জমা দিয়েছেন।
অপরদিকে চাঁদপাই (মংলা) স্টেশন কর্মকর্তা ফরেস্ট রেঞ্জার গাজী মতিয়ার রহমান জানান, তাঁদের রেঞ্জে বরাবরই মধুর পরিমাণ কম। সে কারণে পাস পারমিটও কম হয়। যারা মধু সংগ্রহে গিয়েছিল তারা খালি হাতেই ফিরছে বলে জানান তিনি।
বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (ওয়াইর্ল্ড লাইফ) খুলনা অঞ্চলের ডিএফও মো. জাহিদুল কবির বলেন, মধু আহরণের সময় চাকের কিছু অংশ রেখে দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে ওই অংশে আশ্রয় নেওয়া রানি মৌমাছিকে ঘিরেই পুরুষ মৌমাছিরা সেখানে চাক তৈরি করে। মৌয়ালদের ভুলের কারণেও এমনটা হতে পারে। এ ছাড়া এ বছর অনাবৃষ্টির কারণে বনে ফুলের সংখ্যা কম। তাই খাদ্য সংকটেও মৌমাছিরা অন্যত্র চলে যেতে পারে। তবে এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধ্যান না করে সঠিক কারণ বলা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।