২২ বছর ধরে সম্মেলন হয় না, সভাপতিও নাগালের বাইরে

সম্মেলন করে খুলনা জেলা বিএনপির কমিটি করা হয় সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে। শহীদ হাদিস পার্কে আয়োজিত ওই সম্মেলনে সভাপতি হন সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী, সাধারণ সম্পাদক হন মইন সরদার। শেখ রাজ্জাক আলী আর নেই। গত ২২ বছর ধরে সম্মেলনের মাধ্যমে আর কমিটি হয়নি।
গত এক দশক থেকে জেলা বিএনপির সভাপতির পদে আছেন অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম। তিনি প্রায় তিন বছর ধরে খুলনায় আসেন না, খুলনা মহানগরীতে তাঁর কোনো বাড়িও নেই। জানা যায়, খুলনা এলে তিনি তারকা খচিত হোটেলে অবস্থান করেন, যেখানে থানা পর্যায়ের কোনো নেতারা প্রবেশই করতে পারেন না। এভাবেই গত ২২ বছর ধরে চলছে খুলনা জেলা বিএনপি। এ ছাড়া বেশির ভাগ স্থানীয় নেতা নাশকতার মামলার আসামি হওয়ায় জেলা বিএনপির অবস্থা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে।
২২ বছর আগে সর্বশেষ সম্মেলন
খুলনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘১৯৯৪ সালে শহীদ হাদিস পার্কে সম্মেলন করে জেলা বিএনপির কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন, ফরিদা রহমান এবং কমিটির সভাপতি হন তৎকালীন স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী আর সাধারণ সম্পাদক হন মইন সরদার।
কিন্তু স্পিকার রাজনৈতিক দলের পদ গ্রহণ নিয়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তুললে পরে শেখ রাজ্জাক আলী দলের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর থেকে আর সেই ভাবে সম্মেলন করে কমিটি হয়নি।
২০০৩ সালে জেলা বিএনপির নেতাদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামকে সভাপতি আর শফিকুল আলম মনাকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে ক্যাসেল সালাম হোটেলে অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামের কক্ষে একই কমিটি বহল রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সভাপতি আসেন না এলাকায়
বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা স্বীকার করেন, কমিটির সভাপতি গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে খুলনায় আসেন না। তিনি জানান, জেলা বিএনপির ভাগ্যবান সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশে একমাত্র অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামের নামে এবার কোনো মামলা হয়নি। তাঁর অনুপস্থিতিতেই বিভিন্ন সময় জ্যেষ্ঠ নেতাদের দিয়ে কর্মসূচি পালন করা হয়।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা তাঁর সভাপতি নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি জানান, তিনি তাঁর সভাপতি অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামকে বহুবার বলেছেন খুলনা মহানগরীতে একটি বাড়ি কিনতে। যেন কর্মীরা নিদিষ্ট একটা ঠিকানা পায় তাঁদের সভাপতির সঙ্গে দেখা করার। তিনি জানান, সভাপতি আগে যখন খুলনা আসতেন তখন কখনো ক্যাসেল সালাম, সিটি ইন, বা রয়েল হোটেলে অবস্থান করেন। তিনি আরো জানান, উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে সভাপতির যোগাযোগ হয় কি না তা জানেন না। তবে সভাপতির সঙ্গে তাঁর (শফিকুল) মাঝে মাঝে মুঠোফোনে কথা হয়।
শফিকুল আলম মনা বলেন, ‘মাঠের নেতাকর্মীদের দিয়ে কমিটি না করলে সাংগঠনিক ভাবে দল দুর্বল হয়ে যায়।’ জেলা বিএনপির সভাপতিকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটির বৈঠক কবে করেছেন তা মনে করতে পারেননি তিনি।
এ ব্যাপারে খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক মাজিদুল ইসলামের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে একাধিক বার কল দিলেও তিনি কথা বলেননি।
মামলায় ভেঙে পড়ছে নেতৃত্ব
শফিকুল আলম মনা জানান, গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিতে গেলে আদালত তাঁকে জেলে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন আগে জামিনে মুক্তি পান শফিকুল। তিনি জানান, তাঁর নিজের নামে ছয়টি নাশকতার মামলাসহ ৯ উপজেলা আর দুই পৌরসভার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের নামে দুই শতাধিক মামলা আছে। তিনি বলেন, ‘ডুমুরিয়া আর দাকোপ থানা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া অন্য কোনো থানা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এলাকায় নাই বা যেতে পারেন না মামলার ভয়ে।’
শফিকুল তেরখাদা থানার একটি নাশকতার মামলার বিবরণ দিয়ে জানান, একটি গাড়ি পোড়ানো মামলা তিনি প্রধান আসামি, এরপর থাকে থানা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম। পরে প্রতিটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে। মামলার বাদী আদালতে জানান, তিনি কারো নাম উল্লেখ করেননি। তারপরও চলছে পুলিশের হয়রানি।
মামলার পাশাপাশি দলীয় নেতারা অভিযোগ করেছেন পুলিশের হয়রানির বিরুদ্ধেও। পুলিশের হয়রানির ও বাধার কারণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে না কোনো কর্মসূচি।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে সাজার রায় ঘোষণার পর মাঠ পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের চাপে বটিয়াঘাটা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আমীর এজাজ খানের উদ্যোগে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। গত ২৩ জুলাই সকালে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে সভাপতিত্বে করেন রূপসা উপজেলা বিএনপির সভাপতি শেখ আব্দুর রশিদ। কর্মসূচিতে থাকলেও পুলিশের অনুমতি না থাকায় মিছিল বের করতে পারেনি দলটি।
নেতৃত্বে সমন্বয়হীনতা ও আওয়ামী লীগে যোগদান
এক সময় মহানগর ও জেলা বিএনপি কেন্দ্র ঘোষিত সব কর্মসূচি একসঙ্গে পালন করত। কিন্তু কেন্দ্র হতে এক নেতার এক পদ ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই জেলা আর মহানগর একত্রে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায় না।
ফুলতলা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠু জানান, ২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে খুলনা জেলায় তিনি বিএনপির হয়ে একমাত্র তিনিই জয়ী হন। অথচ দলের থানা সভাপতির একটি অংশ প্রকাশ্যে সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছে। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত সরদার আলাউদ্দিন মিঠুকে এখন আর কোনো দলীয় কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায় না।
২০১৪ সালের মার্চ মাসে বিএনপির আন্দোলন চলাকালে খুলনা মহানগরীতে কথিত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন কয়রা উপজেলা যুবদল নেতা মিজানুর রহমান মিজান। কিন্তু সকালের দুঘটনায় বিকেল পযর্ন্ত তাঁকে শনাক্ত করার জন্য জেলা বিএনপির কোনো নেতাকে মুঠো ফোনে পাওয়া যায়নি। পরে মহানগর বিএনপি যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম তাঁকে শনাক্ত করেন নিহত ব্যক্তি কয়রা যুবদলের নেতা মিজানুর রহমান।
মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু জানান, তাঁর মহানগরী কমিটির নেতাকর্মীদের মামলার তদারকির পাশাপাশি জেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিযোগ আর মামলার দেখভাল করতে হয়।
খুলনা জেলা বিএনপির তুখোড় নেতা হিসেবে সাংগঠনিক সম্পাদক আমীর এজাজ খান ও মনিরুজ্জামান মন্টুর নাম কর্মীদের কাছে পরিচিত ছিল। কিন্তু গত ২২ বছরে জেলা বিএনপির ড্রয়িংরুম-হোটেল কক্ষ সভায় তাঁরাও নিষ্ক্রিয় ও হতাশ হয়ে পড়েছেন।
এ অবস্থায় খুলনা জেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা মোটর বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব আসনের সংসদ সদস্য মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের কাছে নৌকা উপহার দিয়ে কয়েকশ অনুসারী নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান জানান, বিএনপি ও জামায়াতের অনেকেই আছে যোগদানের পাইপ লাইনে। কিন্তু তাদের মামলা ও কর্মকাণ্ড পরীক্ষার জন্য একটু সময় নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বিএনপি অনেক নেতা-কর্মী যোগদানের লাইনে আছে , তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা চলছে।’