ডেটলাইন : ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/07/26/photo-1469542266.jpg)
রাজধানীর কল্যাণপুরের ৫ নম্বর রোডের ‘তাজ মঞ্জিল’। ভবনটি স্থানীয়দের কাছে ‘জাহাজ বিল্ডিং’ নামেও পরিচিত। এই ভবনটিই এখন আলোচনা মূল কেন্দ্রে। কারণ, আজ মঙ্গলবার ভোর থেকে পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে ওই ভবনের বাসিন্দা নয় ‘জঙ্গি’। পুলিশ আহত অবস্থায় একজনকে আটক করে। অভিযানে সামান্য আহত হন পুলিশের এক সদস্য। আর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সন্দেহভাজন আরেক জঙ্গি।
পুলিশ এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’। এ অভিযান নিয়ে মঙ্গলবার সকালে ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন ডিএমপির কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জঙ্গিদের সবারই বয়স ছিল ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত ছিল। তাদের পরনে ছিল কালো পাঞ্জাবি, জিনসের প্যান্ট। একজন ছাড়া সবার পায়ে ছিল কেডস।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, গত ২০ জুন ‘জঙ্গিরা’ বাসাটি ভাড়া নেয়। এর পর থেকেই হামলার পরিকল্পনা করছিল তারা।
পুলিশের দাবি, ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’ অভিযান সবচেয়ে সফলতম অভিযান। আর আইজিপি এ কে এম শহীদুল হত এ জন্য কৃতিত্ব দেন পুলিশের বিশেষায়িত দল ‘সোয়াত’কে।
রাত সাড়ে ১২টা
ডিএমপির উপকমিশনারের (ডিসি-মিরপুর) নেতৃত্বে ব্লক রেড হচ্ছিল। কল্যাণপুরের ৫৩ নম্বর তাজ মঞ্জিল বাড়িতে যখন ব্লকেড হয়, তখনই ঘটে ঘটনা। বাড়িটি ছয় তলার। ওই বাড়ির পাঁচতলা থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশও পাল্টা গুলি করে। এরপরই পুলিশ পুরো বাড়িটি চারদিকে দিয়ে ঘিরে ফেলে। সন্ত্রাসীরা ভেতরে ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে পুলিশের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে এবং বোমা মারতে থাকে। একপর্যায়ে বাড়ির পেছন দিকে টিনের চালের ওপর দুজন জঙ্গি লাফ দিয়ে পড়ে। এরা পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ করে। তাৎক্ষণিক পুলিশ পাল্টা গুলি করে। পুলিশের গুলিতে একজন আহত হয়। ওই যুবককে আটক করে পুলিশ। আহত অবস্থায় ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আটক ও আহত ওই যুবকের নাম হাসান।
রাত ১টা ৪০ মিনিট
ততক্ষণে পুরো ভবন পুলিশ ঘেরাও করে ফেলেছে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করেনি। তবে অভিযানের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলে পুলিশ। পরিকল্পনার ব্যাপারে জানানো হয় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হককে। পরিকল্পনার কথাটি জানান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার। বিষয়টি জেনে আইজিপি শহীদুল হক মিরপুরের উপকমিশনারকে নির্দেশ দেন বাড়িটি কেবল ঘেরাও করে রাখার জন্য। যেন ভেতর থেকে কেউ পালাতে না পারে। অভিযানটি পরিচালনার জন্য ডিএমপির বিশেষায়িত দল সোয়াতকে ঘটনাস্থলে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে রাতে অভিযান না করে ভোরে অভিযান করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আইজিপির যুক্তি ছিল, রাতে হলে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে।
রাত আড়াইটা
রাত আড়াইটার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সব কর্মকর্তা, ডিএমপির বিশেষায়িত দল-সোয়াতের সদস্যরা। শুরু হয় চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ। সোয়াতসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা এলাকায় ভবনের অবস্থান, সন্ত্রাসীদের অবস্থান, ভেতরের পথ, বাইরের পথ সবকিছু বিবেচনা করে অভিযান পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন), যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিবি), যুগ্ম পুলিশ কমিশনারের (ক্রাইম) নেতৃত্বে অভিযান পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। পরে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ভোর ৫টার পর শুরু হবে অভিযান। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন স্টর্ম টোয়েন্টি সিক্স’।
ভোর ৫টা ৫১ মিনিট
সোয়াতের নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয়। সোয়াতের সঙ্গে থাকে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ এবং অন্যান্য ডিএমপির ফোর্স। এক ঘণ্টা ধরে চলে গুলিবিনিময়। সন্ত্রাসীদের হাতে ছিল সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু পিস্তল। আরো ছিল হাতে তৈরি বোমা। ওদের হাতে গ্রেনেডও ছিল, যা স্থানীয়ভাবে তৈরি। পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধে সন্ত্রাসীরা সবকিছুই ব্যবহার করে। এক ঘণ্টা অভিযান শেষে সোয়াত ঢোকে বাসার ভেতর। নয়জন ‘জঙ্গির’ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গোলাগুলির কারণে এরা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ সময় পুলিশের একজন সদস্যও আহত হয়।
দুপুর আড়াইটা
ডিএমপি কার্যালয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে ব্রিফিং করা হয়। অভিযানের সার্বিক বিষয় নিয়ে ব্রিফিং করেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
যা উদ্ধার করা হয়েছে
ডিএমপি কমিশনার জানান, ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়ভাবে তৈরি ১৩টি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। জেল বিস্ফোরক পাঁচ কেজি, ডেটোনেটর ১৯টি, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল চারটি, ২২ রাউন্ড গুলি, পিস্তল চারটি, ম্যাগাজিন সাতটি, একটি তলোয়ার, তিনটি কমান্ডো চাকু, ১২টি গেরিলা চাকু, আরবিতে আল্লাহু আকবর লেখা দুটি কালো পতাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিট
নিহত জঙ্গিদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য আজ মঙ্গলবার বিকেলে কল্যাণপুরের ‘তাজ মঞ্জিল’ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে তিনটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নয়টি মরদেহ সেখানে পৌঁছায়।