শরীয়তপুরের পদ্মাপাড়ে কান্না আর আহাজারি

‘এই ব্যাডা তুই কে? কইতোন আইছছ? আমার এহেনতোন যা। আমার কেহই নাই। হারা রাইত আমি বৃষ্টিতে বিজজি। অহন আবার কি কইমু। কাইল ভাত খাই নাই। দেহছ না বিস্কুট খাইতাছি।’- ক্ষিপ্ত হয়ে এ =ভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পদ্মার ভাঙনের শিকার হয়ে কুণ্ডেরচর ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আশ্রয় নেওয়া চেহরন বেগম (৭০)।
একটু শান্ত হয়ে এনটিভির প্রতিবেদককে জানান, স্বামী জঙ্গু হাওলাদার ৩০ বছর আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এর পর থেকেই চেহরন বেগম কলমিরচর গ্রামের স্বামীর ভিটে আঁকড়ে একা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলেন। পদ্মার ভাঙনে স্বামীর ভিটে হারিয়ে চারদিন ধরে স্থানীয় বিদ্যালয়ের মাঠে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। গত রাতের বৃষ্টিতে ভিজেছেন সারা রাত।
একই বিদ্যালয়ের বারান্দায় ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন একই গ্রামের ভাঙনের শিকার রাজিয়া বেগম (৬০)। কোথাও জায়গা না পেয়ে তাঁরাও স্কুলের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে আবার বারান্দাতেও আশ্রয় পাননি, ঘর হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।
স্থানীয়রা জানান, গত আগস্ট থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার কুণ্ডেরচর ইউনিয়নে নদীভাঙন প্রকট আকার ধারণ করে। গত কয়েক দিনের ভাঙনে ইউনিয়নটির চৌকিদারকান্দি, মকবুল খালাসীকান্দি, ইছুব মাদবরের কান্দি ও দানেশ মাদবরের কান্দি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আর এই গ্রামের এক হাজারের বেশি পরিবার এখন গৃহহীন।
সরেজমিন দেখা গেছে, জাজিরা উপজেলায় এখনো অব্যাহত রয়েছে পদ্মার ভাঙন। আর পদ্মার পাড়ে চলছে মানুষের কান্না আর আহাজারি। অব্যাহত ভাঙনে দিশেহারা হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে সাধারণ মানুষ।
শুক্রবার সকালে ভাঙনকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীপাড়ের গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই বসতঘর ও আসবাবপত্র সরিয়ে নিয়েছে। আবার ভাঙন আতঙ্কে অনেকেই সরিয়ে নিচ্ছেন ঘরের স্থাপনাও। আর একটু পরপর প্রবল স্রোতে প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ছে নদীর পাড়।
শরীয়তপুরের পদ্মার পাড়েই একসময় ছিল ওই অঞ্চলের সবারই ভিটা। আর তাই চোখের সামনেই ২০০ বছরের পুরোনো বাপ-দাদার ভিটা হারিয়ে যেতে দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জাজিরা উপজেলার মমিন খালাসীকান্দি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামটির ৯০ ভাগই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পদ্মার পাড়ে বসে আছেন রিতা বেগম (৪৫)। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পদ্মার বিশাল জলরাশির দিকে। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাঁর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিতা বেগম বলেন, বুধবার বিকেলে পদ্মার ভাঙনে তাঁর একতলা দালানঘরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এক বছর আগে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এবং ধারদেনা করে ছয় লাখ টাকা খরচ করে ঘর তুলেছিলেন রিতা। স্বামী বিল্লাল ফকির পেশায় কৃষক। এখনো ঋণের দুই লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়নি তাঁর। এই অবস্থায় বাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে তাঁর পরিবার।
শুধু রিতা বেগম, জাহানারা বেগম, চেহরন ও রাজিয়া বেগমই নয়, এই পরিণতি এখন কুণ্ডেরচর ইউনিয়নের পদ্মাপারের সব মানুষের।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয়রা জানায়, পদ্মার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ৬ আগস্ট থেকে কুণ্ডেরচর ইউনিয়নে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। নদীভাঙনে ইউনিয়নটির চারটি গ্রামের ৮৫০টি পরিবারে বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক পাকা স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে হাসেম আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইসমাইল মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, একটি পাকা মসজিদ, সরকারি পাকা সড়কসহ আরো পাঁচ শতাধিক বসতবাড়ি।
পদ্মার ভাঙন বিষয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তহবিল থেকে ৬৭৫টি পরিবারের মধ্যে ৩০ কেজি করে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে ভাঙনরোধে এখনই কোনো ব্যবস্থা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন শরীয়তপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. তারেক হাসান। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, অস্থায়ী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে এই ভাঙন রোধ করা যাবে না। স্থায়ী ভাঙনরোধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকল্প তৈরি করে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।