তিন মাসে সমুদ্রপথে পাচার ২৫ হাজার, নিহত ৩০০
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2015/05/09/photo-1431172050.jpg)
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে দালালরা বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিকে মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে পাচার করেছে। এ সময়ে ক্ষুধা, পানিশূন্যতা ও নির্যাতনে সমুদ্রেই মারা গেছেন ৩০০ জন। মানবপাচারের এ সংখ্যা গত বছরের এই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্রে অবৈধ অভিবাসীদের পারাপারের ওপর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জাতিসংঘ এ প্রতিবেদন তৈরি করে। গতকাল শুক্রবার ইউএনএইচসিআর প্রতিবেদনের আলোকে একটি বিবৃতি দিয়েছে।
মানবপাচারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংস্থাটি জানায়, দালালের মাধ্যমে যাওয়া এসব অবৈধ অভিবাসীরা টাকার জন্য যাত্রা পথেই শিকার হন নানা নির্যাতনের, অনেক সময় তাঁদের গুলিও করা হয়। যারা উপকূলে পৌঁছাতে সক্ষম হন, তাঁদের স্থান হয় থাইল্যান্ডের দক্ষিণের অস্বাস্থ্যকর ‘বন্দিশিবিরে’। তাঁদের লড়তে হয় বেরিবেরির মতো রোগের সাথে। আর যাঁরা শেষ পর্যন্ত দালালদের ‘প্রত্যাশিত’ টাকা দিয়ে ছাড়া পান, তাঁদের ঋণ মেটানোর জন্য এবং অবৈধ অবস্থায় টিকে থাকার জন্য কঠোর জীবন-সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়।
পাচারের শিকার, বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে আসা এবং উদ্ধার হওয়া ভুক্তভোগীদের সাথে সাক্ষাতের ভিত্তিতে জাতিসংঘ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। অবৈধ অভিবাসীদের উদ্ধারের জন্য সংস্থাটি থাইল্যান্ড সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি গত আগস্ট থেকে সমুদ্রপথে পাচাররোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে পরামর্শ করে আসছে সংস্থাটি।
বিবৃতিতে জানানো হয়, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার কর্মীরা পাচারকারীদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়াদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা জানান, পাচারকারীরা নানা ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে তাঁদের নৌযানে উঠতে উৎসাহ জোগায়। প্রাথমিকভাবে অনেককে নৌযানের কোনো ভাড়াও দিতে হয় না। মালয়েশিয়ায় চাকরিতে যোগ দিয়ে বেতন পাওয়ার পর টাকা দেওয়ার শর্তে মানুষদের নৌযানে তুলে নেয় দালালরা। এমনকি চাকরির মিথ্যে আশ্বাসের পাশাপাশি অনেক সময় তাঁদের টাকাও দেওয়া হয়।
জাতিসংঘ জানতে পেরেছে, যদি তাঁদের মধ্যে কেউ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সমুদ্রপথে যেতে রাজি না হয়, তখন তাঁদের জোর করে ধরে রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তা থেকে শিশু কিংবা সমুদ্রে মাছ ধরার নৌযান থেকেও দালালরা অনেককে জোর করে তাদের নৌযানে তুলে পাচার করে দেয়।
পাচারকারীদের হাত থেকে বেঁচে আসা এমন এক জীবিত ব্যক্তি ইউএনএইচসিআরকে জানিয়েছেন, তিনি দালালদের এমন একটি নৌযানে ৬২ দিন অতিবাহিত করেছেন। ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি নৌযানটিকে একটি কবরস্থানের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং জানিয়েছেন তিনি জীবিত অবস্থায় তীরে পৌঁছানোর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
জীবিতদের বেশির ভাগই সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা রানংয়ে ভেড়ার কথা জানিয়েছেন। রানং থেকে একদিনের পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা পৌঁছাতেন মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছে পাচারকারীদের ‘বন্দিশিবিরে’। এসব শিবিরের পরিবেশ ভয়াবহ। এখানে অবৈধ অভিবাসীদের আটকে রাখা হয় এবং মুক্তিপণ না পর্যন্ত তাঁদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন।
মানবপাচারকারীদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়াদের অর্ধেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে ইউএনএইচসিআর। তাঁরা জানিয়েছেন, যে শিবিরে তাঁদের আটকে রাখা হয়েছিল সেখানে অনেকেই মারা গেছেন। তাঁদের মারধর করা হতো, অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে গুলি করা হতো।
বিবৃতিতে ইউএনএইচসিআর আরো জানায়, মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার পর আটকদের মাছ ধরার নৌকা বা স্পিডবোটে করে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হতো।
বেসরকারি সংস্থা দি আরকান প্রজেক্টের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, কয়েক হাজার মানুষ এখনো এই সব শিবিরে বন্দী হয়ে আছেন এবং অনেকে মারা গেছেন। বন্দিশিবিরগুলোতে মানবেতর জীবনযাপনের জন্য ভিটামিনের অভাবে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন বন্দিরা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৬১ জন রোহিঙ্গা এ ধরনের রোগ নিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছান। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। কিন্তু মুক্তিপণের জন্য চড়া সুদে নেওয়া ঋণের টাকা শোধ দিতেই তাঁদের সব উপার্জন শেষ হয়ে যায়।
জাতিসংঘ বিবৃতিতে জানায়, থাইল্যান্ডে পাচারকারীদের শিবির থেকে উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে ইউএনএইচসিআর কাপড়, কম্বলসহ অন্যান্য ত্রাণ বিতরণ করেছে। দেশ থেকে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়ার পথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে সহায়তাও করবে সংস্থাটি। এ ছাড়া বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পুনর্বাসনের চেষ্টাও চালানো হচ্ছে বলে ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় সংখলার পেদাং বেসার এলাকায় একটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এর আগে এর পাশেই আরেকটি গণকবর পাওয়া যায়, যেখান থেকে অন্তত ১০ বাংলাদেশিসহ ২৬টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মানবপাচার এবং বন্দিশিবিরে অকাতরে মানুষ হত্যার ঘটনায় বিশ্ব গণমাধ্যমে আলোচনার মধ্যেই গতকাল শুক্রবার থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের আলোচিত শংখলা প্রদেশের পেদাং বেসার শহরের মেয়র বোনজং পংফনকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটিতে মানবপাচার প্রতিরোধে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স। সংস্থাটি মেয়রকে মানবপাচারকারী দলের প্রধান বলে সন্দেহ করছে।