নওগাঁর ধামইরহাট-পত্নীতলা সীমান্তে মাদকের ঢেউ

নওগাঁর ধামইরহাট আর পত্নীতলা সীমান্তে নিত্যপণ্যের মতোই মাদক বিক্রির অভিযোগ পুরোনো। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনগণের ক্ষোভ এবং আক্ষেপের কথাটিও দীর্ঘদিনের। ভারত থেকে স্রোতের মতো আসা মাদক ঠেকাতে স্থানীয় জনগণ এর আগে বিভিন্ন প্রতিবাদ, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করলেও কোনো ফল হয়নি। বরং এলাকাদুটিতে দিন-দিন মাদক বিক্রি বেড়েই চলেছে।
অবাধে এই মাদক ব্যবসার রমরমার জন্য ওই এলাকার পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতাকে দায়ি করেন স্থানীয়রা। এলাকার সচেতন মহলও এ অবস্থার জন্য দুষছেন আইন শৃংখলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে।
সরেজমিন জানা গেছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমে ভারত সীমান্তে লাগোয়া ধামইরহাট ও পত্নীতলা উপজেলার সীমান্ত রয়েছে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার। সীমান্তে কোথাও কাঁটাতারের বেড়া আছে, কোথাও আবার নেই।
কাঁটাতারের সীমান্ত না থাকার সুযোগে অনেক এলাকাতেই দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে ভারতের তৈরি বিভিন্ন মানকদ্রব্য আনছে চোরাকারবারীরা। অনেক সময় আবার কাঁটা তারের বেড়া কেটে সুরঙ্গ তৈরী করে মাদক পারাপার করছেন দুই দেশের চোরাকারবারীরা। পানি চলাচলের ব্রীজের নিচ দিয়েও নিয়ে আসা হয় মাদক।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় নিয়মিত ধামইরহাট-পত্নীতলা সীমান্ত পেরিয়ে দেশে ঢুকছে নিষিদ্ধ মাদক। সীমান্তের দুই উপজেলার অন্তত ২০ থেকে ২৫টি চোরাই পথে আনা হয় ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা। সবচেয়ে বেশী আসছে ভারতীয় নিষিদ্ধ ফেনসিডিল। সীমান্তে বিজিবির হাতে দু-একটি চালান আটক হলেও অধিকাংশই থাকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেক ক্ষেত্রে আবার মাচকের চালান আটক করলেও মাদক বহনকারীদের ধরতে পারছে না বিজিবি।
পত্নীতলা উপজেলার নির্মইল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতায় সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোতে চলছে মাদকের রমরমা পাইকারী বেচা-কেনা। ভারত থেকে মাদক দ্রব্যের চালান আসছে, আবার হাত বদল হয়ে সেগুলো যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এ ক্ষেত্রে বাহক হিসেবে বেশী কাজ করছেন নারীরা।
সীমান্তবর্তী এ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আরো জানান, পত্নীতলা উপজেলায় মাদকের সবচেয়ে বেশী রমরমা ব্যবসা হয় ডাঙ্গাপাড়া, পত্নীতলা বাজার, মধইল বাজার, চকমূলি, নির্মইল, কৃষ্ণপুর, শিয়ারা, দীবর, পাটিচারা, কাশিপুর, গাহন, বাগুড়িয়া, সাদিগ্রাম ও কেশবপুর গ্রামে।
এসব এলাকার শহরাঞ্চলে খুচরাভাবে মাদক বিক্রি হলেও অধিকাংশ গ্রামে চলছে মাদকের পাইকারী বিক্রি। স্থানীয় বসবাসকারী অসাধু ব্যক্তিরা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও অধিকাংশ চোরাকারবারী দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে এসে আস্তানা গেড়েছে ধামইরহাট ও পত্নীতলায়।
ধামইরহাট উপজেলার ইসবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু ওয়াদুদ জানান, ধামইরহাট উপজেলার আলতাদীঘি, হরিতকী ডাঙ্গা, ফার্সিপাড়া, আমাইতারা, মালাহার, রাঙ্গামাটি ও দৌলতপুরে সবচেয়ে বেশী মাদক বিক্রি হয়। উমার ইউনিয়নের দৌলতপুরে মাদকের চালান সবচেয়ে বেশি বেচা-কেনা হয় বলে জানান তিনি।
আবু ওয়াদুদ বলেন, মাদকের এই অবাধ সরবরাহের ফলে একদিকে যেমন এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বিপথে যাচ্ছে যুব সমাজ। ধামইরহাটের বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হলেও পুলিশ নির্বিকার বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
ধামইরহাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের কমান্ডার আব্দুর রউফ জানান, সীমান্ত দিয়ে মাদক এনে পাশের জয়পুরহাট ও নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত কিছু রাস্তা-ঘাট রুট হিসেবে ব্যবহার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্যান্য স্থানে। এ অঞ্চলে আক্কেলপুর, তিলকপুর ছাতিয়ান গ্রাম ও সান্তাহার মাদকের সবচেয়ে প্রচলিত পথ বলে জানান তিনি।
কমান্ডার আব্দুর রউফ অভিযোগ করে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রনে এ এলাকার পুলিশ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতা রয়েছে। অসাধু কর্মকর্তারা মাদক চোরাচালানকারীদের আটকের পর অবৈধ সুবিধা নিয়ে আইনের দুর্বল ধারায় মামলা রুজু করে তাদের বিরুদ্ধে। ফলে কদিন পরেই জেল থেকে বেড়িয়ে আবারো অপকর্ম করার সুযোগ পায় তারা। মাঝে মধ্যে চোরাকারবারীরা আটক হলেও সবসমই গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এ অবস্থায় প্রশাসনের উপর মহলের কঠোর নজরদারীর পরামর্শ দেন তিনি।
তবে এ বিষয়ে নওগাঁর পুলিশ সুপার (এসপি) মো.মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মাদক নির্মূলে নওগাঁয় পুলিশের অবস্থান জিরো টলারেন্স। যে কোন উপায়ে সমাজ থেকে মাদক দূর করা হবে।’ এ জন্য মাদক বিক্রির সম্ভাব্য স্থানগুলোতে নিয়মিত চিরুনী অভিযান চালানো হয় বলে জানান তিনি।
মো.মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত মাদক উদ্ধার ও মাদক বিক্রেতাকে আটক করে পুলিশ আইনের কাছে সোপর্দ করছে । প্রতিটি থানায় আগের চেয়ে মাদকের মামলার সংখ্যা বেড়েছে।’
মো.মোজাম্মেল হক জানান, তিনি নওগাঁয় যোগদান করে মাদক নির্মূলে কাজ শুরুর ৯ মাসে জেলার ১১টি থানায় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে প্রায় সহাস্রাধিক মামলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন মাদক বিক্রেতাকে আটক করেছে পুলিশ। জেলায় মাদক দ্রব্য সেবন ও বিক্রি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে দাবি করে তিনি বলেন- সীমান্ত এলাকার থানাগুলোতে মাদক নিয়ন্ত্রনে বিশেষ নজর রাখা হয়েছে।
পুলিশ মাদক বিক্রেতাদের চিহ্নিত করে ডাটাবেজ তৈরীর কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামীতে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে মোটিভেশন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে। এছাড়া মাদক মামলায় পুলিশের গাফেলতি অথবা ধারা পরিবর্তন করে মামলা রুজু করার কোন ঘটনা তাঁর জানা নেই বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে বিজিবি-১৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো.আলী রেজা বলেন, সীমান্তে মাদকসহ সব ধরনের চোরাচালান রোধে কঠোর নজরদারী রয়েছে বিজিবির। আগের চেয়ে মাদকের চোরাচালান নিয়ন্ত্রনে বলে দাবি করেন তিনি। তবে যোগাযোগ করা হলে সাম্প্রতিক কোনো মাদক উদ্ধার অভিযানের তথ্য দিতে পারেননি তিনি।