‘আইতাছি কইয়া আর আইল না, আমার মানিক মাথায় গুলি খেয়ে মরল’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/07/25/gavi.jpg)
কাঠ আর টিনের তৈরি দোতলা ঘর। নিচতলায় তিনটি দুধেল গাভী। উপরে বসে ফরিদা বেগম কাঁদছেন। ঘরে একটি কলস রাখা। কলসের দিকে হাত নেড়ে ফরিদা বিলাপ করছিলেন, ‘এই কলসে করে আমার ছেলে মহল্লায় দুধ দিতে যেত। সেই দুধ দিতে গিয়ে আর ফিরল না আমার মোবারক হোসেন। গ্রিন রোডে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শুক্রবার মারা গেল। আমার বুকের মানিক আজ আজিমপুর কবরস্থানে শুয়ে আছে।’
এ কথা বলতে বলতে ফরিদা বেগমের কথা থেমে যায়। আর কথা বলতে পারছিলেন না। কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু কথা বের হচ্ছিল না। এ দৃশ্য দেখে ওই ঘরে থাকা ফরিদার মেয়ে জহুরা আক্তার রত্না কেঁদে ওঠেন। পাশে ছিলেন আরও দুই নারী, তারাও কেঁদে ওঠেন। সেখানে এক নারীর কোলে ছিল আরেক শিশু। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে শিশুটিও কেঁদে ওঠে। রাজধানীর কাঁঠালবাগানের বক্স কালভার্ট রোডের টিনের ওই ঘরটির বাতাস আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ভারী হয়ে ওঠে।
মোবারক হোসেন গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) দুপুরে বাসা থেকে এক বোতল দুধ নিয়ে বের হয়। যাওয়ার সময় মা ফরিদা বেগমকে বলে যায়, ‘আম্মা, আমি এক জায়গায় দুধ দিয়া নামাজ পড়ে বাসায় আমু।’ এ কথা বলতে বলতে ফরিদা আবারও ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলতে থাকেন, ‘আমার মানিক দুধ দিতে বের হয়ে মাথায় গুলি খেয়ে মরল। আমার কাজ করে দিবার আর কেউ থাকল না।’
আজ বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) দুপুরে যখন ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ফরিদা আর তাঁর মেয়ে বাসায় ছিলেন। বাবা রমজান আলী দুধ দিতে গিয়েছিলেন কাঁঠালবাগান এলাকায়। পরিবার জানায়, রমজান আলীর বড় ছেলে হযরত আলী রতন। তাঁর আলাদা সংসার। ওই বস্তির পাশের আরেকটি কক্ষে তিনি স্ত্রী-সন্তানসহ থাকেন। মূলত মোবারক হোসেন আর রমজান আলী তিনটি গাভী দেখাশোনা করে। গাভী তিনটি প্রতিদিন প্রায় ২০ লিটার দুধ দেয়।
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/07/25/in_1.jpg 687w)
ফরিদা বেগম তখন বলছিলেন, ‘আমি ঘুম পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে মোবারকের আব্বার কাছে জানতে চাই, আমার পোলা কই? আমার পোলা তো আহে নাই। আমাকে বলে দুধ দিয়ে আহে নাই? আমি বলি না। তখন আমি ফোন দিছি মোবারককে। মোবারক কইল, আমি আইতাছি। গ্রিন রোডে আছি। ওর আব্বা বলতেছে, তাত্তাড়ি আয়। পরে ওর আব্বা আর আমি আসরের নামাজ পড়ি। তারপরও ছেলে আসে নাই। সে সময় ওর আব্বা আমাকে বলে নিচে চল। এই টাইমে মানুষে খবর নিয়ে আইছে, আমার ছেলেকে গুলি করে মারছে! এ কথা বলতে বলতে এবার তিনি টিনের দেয়ালে হেলান দিয়ে পড়ে যান। কাঁদতে থাকেন।
মোবারকের মা ফরিদা যখন কাঁদছিলেন, তখন রমজান আলী কলস হাতে বাসায় ফেরেন। সে সময় রমজান আলী স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে বলছিলেন, ‘কেঁদ না, ছেলের জন্য দোয়া কর। শান্ত হও। আল্লাহ মোবারককে ভালো রাখুক।’ এ দৃশ্য দেখে ঘরে থাকা সবাই আবার কেঁদে ওঠেন।
সে সময় রমজান আলী বলছিলেন, ‘কাঁঠালবাগান এলাকায় দুধ দিয়ে মোবারক জুমার নামাজ পড়ছে। নামাজ শেষে ওর সমবয়সী কয়েকজন মিলে গ্রিন রোডের স্টাফ কোয়ার্টারের খেলার মাঠে যাচ্ছিল। গিয়ে দেখে ওদিকে অনেক ঝামেলা। এসব কথা আমি ওর বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি। আসতে দেরি হচ্ছে বলে আমরা ফোন দিলাম। তখন বলল, দ্রুত আইতাছি। আসার সময় হয়তো মাথায় গুলি লেগেছে।’
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2024/07/25/in_2_1.jpg 687w)
রমজান আলী বলেন, ‘আমরা দ্রুতই যাই গ্রিন রোডে। গিয়ে দেখি, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে মোবারককে রাখা হয়েছে। শনিবার পর্যন্ত ওখানে রাখা ছিল। এক লাখ ৫ হাজার টাকা বিল আসে। আমরা গরীব বলে মেডিসিনের ১৭ হাজার টাকা নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারপর পোস্টমর্টাম শেষে রোববার ঢাকা মেডিকেল থেকে সন্তানের লাশ নিয়ে আসি। পান্থপথ জামে মসজিদে নিয়ে যাই। আমি নিজে গোসল করাই আমার ছেলেকে। তখন দেখি, কপালের বাঁ পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। বহু লোক হয়েছিল জানাজায়। এরপর যখন আজিমপুর কবরস্থানে লাশ দাফন শেষ হয়, তখন মাগরিবের আজান দেয়।’