স্বামী দাবি করে দুই স্ত্রীর মামলা, মরদেহ ১০ বছর হিমাগারে
ভিন্ন ধর্মের দুই স্ত্রীর মামলায় স্বামী রাজিব নন্দি ওরফে রাজিব চৌধুরী ওরফে খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরীর মরদেহ ১০ বছর ধরে বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে পড়ে আছে। তবে রাজিবকে হিন্দু দাবি করে এক স্ত্রীর বিচারিক আদালতের আবেদন কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আজ মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) বিচারপতি জাকির হোসেনের একক বেঞ্চ এ আদেশ দেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর পক্ষে শুনানি করেন আডভোকেট শিশির মনির।
রাজিব চৌধুরী ওরফে খোকনের চিতা নাকি কবর, দাহ নাকি দাফন—দীর্ঘ এই ১০ বছরেও এর সুরাহা হয়নি। এ কারণ, খোকনের দুই স্ত্রীর একজন হিন্দু ও একজন মুসলিম। দুই পক্ষই খোকনের মরদেহের শেষকৃত্য করতে চান নিজ নিজ ধর্মমতে। এ কারণে বিষয়টি গড়িয়েছে এখন হাইকোর্টে।
বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও এর মীমাংসা হয়নি। ফলে হাইকোর্ট খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকা চৌধুরী ওরফে রাজীব চৌধুরীর মরদেহ হিমাগারেই রাখার নির্দেশ দিয়েছে। সেই থেকে খোকন নন্দীর স্থান হয়েছে হিমাগারেই। কিন্তু এখন মরদেহের অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ১৪ জুন খোকন চৌধুরী অসুস্থ হন। এরপর দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আকতার খানম ওরফে বাবলি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ জুন সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। এরপর হাসপাতাল থেকে তার সঙ্গে থাকা দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আকতার খানম ওরফে বাবলি স্বামীর মরদেহ নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু খোকন চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী মিরা নন্দী এবং তার দুই সন্তান বাবুল ও চন্দনা এতে বাধা দেন। তারা দাবি করেন, তাদের বাবা খোকন নন্দীর লাশ তারা নিয়ে হিন্দুধর্ম মতে সৎকার করবেন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। আর এই দুপক্ষের বিরোধের কারণে তৎকালীন রমনা থানা ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করে। তারা না পারায় বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার সহকারী জজ আদালত (দেওয়ানি মামলা নম্বর ২৫২/১৪, ঢাকা) বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ও তদারকিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে খোকনের মরদেহটি সংরক্ষণের আদেশ দেয়। এরপর ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও মরদেহটি হিমঘরে পড়ে রয়েছে।
দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা খানমের ভাষ্য, খোকন নন্দী মুসলমান হয়ে খোকন চৌধুীর নাম রেখেছিলেন। তাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই। এর আগে হাবিবুর রহমান নামে প্রথম শ্রেণির একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে খোকন ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বিয়ের কাবিননামা, এফিডেভিট রয়েছে। খোকন চৌধুরী আমার স্বামী এবং মুসলমান—এটা প্রমাণের জন্য আর কী প্রয়োজন?
হাবিবা খানম আরও জানান, খোকনের চার ভাইয়ের মধ্যে দুভাই জহরলাল নন্দী ও সাগর নন্দী রাজধানী ঢাকায় থাকতেন। তখন খোকন ও বাবলি উত্তর শাহজাহানপুরের ৩৩১ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। সেখানে খোকন চৌধুরীর ভাই সাগর নন্দী প্রায়ই আসা-যাওয়া করতেন। আর সাগর নন্দী দীর্ঘদিন তেজতুরি বাজারে থাকতেন।
ফার্মগেটে খোকন চৌধুরীর মার্কেটের সামনে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, খোকন চৌধুরী আগে হিন্দু ধর্মের ছিলেন। কিন্তু পরে তার চালচলনে মুসলমান হিসেবেই মনে হতো। আর অনেকেই তাকে খোকা ভাই বলে ডাকতেন। তিনি সকালে শাজাহানপুরের বাসা থেকে বের হতেন, আর রাতে বাসায় ফিরতেন। এ জন্য আশপাশের লোকজনের সাথে তাঁর তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তবে মাঝে মাঝে শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে স্থানীয় মসজিদে যেতেন খোকন। এ ছাড়া প্রতি ঈদুল-আজহায় গরু কিনে কোরবানি দিতেন খোকন-বাবলি দম্পতি। গরু কোরবানির পর মাংসও বিতরণ করতেন খোকন নিজেই। স্থানীয় দোকানদারসহ অনেককেই তিনি কোরবানির গরুর মাংস দিতেন। কুরবানি দিতেন খোকার শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ বাবলির বাবার বাড়ি সিদ্ধেশ্বরীতে। উত্তর শাহজাহানপুরে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে ছিলেন এই দম্পতি। ওই বাড়ির বাসিন্দারাও খোকনকে একজন মুসলমান হিসেবেই জানতেন।
এর আগে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকন নন্দীর প্রথম পক্ষের সন্তান ও তার স্ত্রীর অভিযোগ, হাবিবা আকতার খানম বাবলির জাতীয় পরিচয়পত্রে তার বাবার নাম মৃত হাবিবুর রহমান, মায়ের মঞ্জুরা বেগম, জন্ম তারিখ ২ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সাল ও বাসার ঠিকানা ১১/১ সিদ্ধেশ্বরী উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু স্বামী হিসেবে কারও নাম উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে হাবিবা খানম জানান, ভোটার হওয়ার সময় এ বিষয়টি চিন্তা করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকার সময় তার সঙ্গে খোকন নন্দীর পরিচয় হয় পুরানা পল্টনে একটি চটপটির দোকানে। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরে ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর ১৯৮৬ সালে প্রথম স্ত্রী মীরাকে ডিভোর্স দেন খোকা। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
খোকনের গ্রামের বাড়ি মহেশখালীর জামালপাড়া গ্রামে। পারিবাকির কলহের কারণেই খোকা ধর্মান্তরিত হয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা খানম বাবলি জানান। বাবলিকে নিয়ে অনেকবার খোকা কক্সবাজারেও বেড়াতে গিয়েছিলেন। তার ভাই-বউদের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি চ্যানেলেও তারা সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন আমাকে তারা চেনেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোকন নন্দীর মার্কেটের লোকজন জানান, খোকন ধর্মান্তরিত হওয়ার পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও তার ছোট ভাই সাগর ছাড়া আর কেউ তাকে দেখতে বারডেম হাসপাতালে যেতেন না।
হাবিবা আরও জানান, গত ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে খোকন নন্দী একবার অসুস্থ হন। তখন তাকে কলাবাগানের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে কক্সবাজারের মহেশখালীতে থাকা তার ছোটভাই শান্তি নন্দীকে ফোনে বলেছিলেন, তোরা কি আমাকে দেখতে আসবি না? তখন শান্তি বলেছিলেন, আপনি মুসলমান। এসে কি করব? আমরা তো আপনার লাশও পাব না। তবে বারডেমে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে এসেছিলেন খোকনের অন্য ভাইয়েরা। আর বারডেমে ভর্তির সময় বাবলি ফোনে ডেকে এনেছিলেন খোকনের ম্যানেজার দুলাল চন্দ্রকে। হাসপাতালের যাবতীয় কাগজে খোকনের নাম খোকন নন্দী লিখিয়েছিলেন দুলাল।