বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সংস্কার করা কঠিন হবে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেছেন, শেখ হাসিনার আমলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে তাদের সংস্কার করা কঠিন হবে। এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকায় কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
এদিকে, আজ মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) বাংলাদেশের সংস্কার নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘আফটার দ্য মুনসুন রেভুলেশন : অ্যা রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’। প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কারের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে নিরাপত্তা বাহিনী শেখ হাসিনার দমনমূলক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করেছে, যা বিরোধী দল, সমালোচক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অবৈধ আটক এবং গুমের ঘটনা ঘটিয়েছে। এক কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, ‘পুলিশের মধ্যে রাজনৈতিকীকরণের কারণে জনমনে তাদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে।’
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আল-জাজিরা জানিয়েছে, তারা তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাইয়ের একটি গোপন ভিডিও ধারণ করেছে, যেখানে তিনি দাবি করেন যে তিনি তার পারিবারিক সম্পর্ক ব্যবহার করে পুলিশকে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করানোর ক্ষমতা রাখেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশই আমাদের গুন্ডাদের মতো কাজ করে। অন্য গুন্ডাদের কী দরকার?’
পদোন্নতি ছাড়াও দমনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনী কখনো কখনো বিশেষভাবে পুরস্কৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের এক মাস পর, সরকার পুলিশ কর্মকর্তাদের ৩৪৯টি পুরস্কার প্রদান করে, যার মধ্যে একজন কর্মকর্তা আল-জাজিরায় ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা’ চালানোর অভিযোগে শাহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করার জন্য পদক পেয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে সড়ক নিরাপত্তা উন্নত করতে এবং সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল, তাদের ওপর নজরদারি ও গ্রেপ্তার করার জন্য ১৫ জন কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করা হয়। বেনজির আহমেদ, যিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞার পড়েছিলেন, তাকে নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে’ র্যাবের প্রধান হিসেবে তার কাজের জন্য পদক দেওয়া হয়েছিল। যে সময় কমপক্ষে ১৩৬টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ১০টি গুমের ঘটনা ঘটেছিল। এর পরে তাকে পুলিশ প্রধান হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যাদের প্রিয়জনেরা গুমের শিকার হয়েছে, এমন অনেক পরিবার বলেছে, যখন তারা পুলিশে অভিযোগ দাখিল করতে চেয়েছিল, তখন পুলিশ কোনো অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং কিছু পরিবার অভিযোগ করেছে, তাদের হুমকি ও হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা এবং নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করেছে, যারা গুম হয়েছে তারা নিজে থেকে লুকিয়ে আছে।
নিরাপত্তা বাহিনীও চাঁদাবাজি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) মুক্তির জন্য মুক্তিপণ দাবি করেছে। অন্যথায়, মাদক পাচারের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সুপারিশ
- নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও আচরণে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার জন্য কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করা।
- কর্মচারী সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ সীমাবদ্ধ করা এবং যারা এই নিয়ম লঙ্ঘন করবে তাদের দায়ী করা।
- একটি স্বচ্ছ পদোন্নতি ও প্রণোদনা ব্যবস্থা স্থাপন করা, যা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে।
- সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সব স্তরের কর্মকর্তা থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে নিষেধ করা।
- আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত সংস্কার করা।
- প্রসিকিউশন ও বিচারব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীন রাখতে পদক্ষেপ নেওয়া।
- জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিক বিশেষ প্রক্রিয়াগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো।
- মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা।