বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগে হতাশা-বিভক্তি
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা মসনদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায় গত বছরের ৫ আগস্ট। তার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ছয় মাস পূর্ণ হলেও আওয়ামী লীগ এখনও নিজেদের অস্তিত্ব ফিরে পেতে ধুঁকছে। ২০২৪ সালের এই দিনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলে তিনি যে দম্ভোক্তি করেছিলেন, সেটি নিমিষেই পরিণত হয় হাস্যরসে। কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই তার পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলটির নেতাকর্মীদের হতবাক করে দেয়। দিশেহারা নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিক যে যার মতো দেশত্যাগ, আত্মগোপনে চলে যেতে শুরু করেন। কেউ কেউ আবার পালাতে গিয়ে ধরাও পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
বিগত ছয় মাসে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সাবেক আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাদের একটি অংশ গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকি নেতারা বিদেশে অবস্থান ও আত্মগোপনে থাকায় দলটিতে দেখা দিয়েছে চরম নেতৃত্ব শূন্যতা। সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, চাঁদাবাজি, দখল, গুম-খুন ও গণহত্যাসহ নানা অপরাধে মামলা হয়েছে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে আদালতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেও বিচার প্রক্রিয়া চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মামলায় দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে।
অপরদিকে, গ্রেপ্তার না হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের এখনও কাউকে প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়নি। আত্মগোপনে থাকা কয়েকজনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ আরও কয়েকজন। এ ছাড়া সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত সম্প্রতি ফেসবুকে আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেজে এক পোস্টের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানান। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সংবিধানে সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। দলটির শীর্ষ নেতাদের এমন অনেক স্বেচ্ছাচারি পদক্ষেপ দলটিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ফলস্বরুপ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গেল আগস্টে পতন ঘটে আওয়ামী সরকারের।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা ভারতে থেকে বিদেশে কয়েকটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে অংশ নেন। এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে নানা দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন এবং তাদের সর্তক অবস্থানে থাকতে বলেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি মশাল মিছিল ও ১৮ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক হরতালের ডাক দিয়েছে দলটি। এর আগে শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে গত ১০ নভেম্বর দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত মাঠে নামতে পারেনি দলটি।
ছয় মাস পরে এসে ভার্চুয়ালি কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে তৃণমূল আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর কথা হয়। তারা জানান, মামলা-হামলার ভয়ে তারা এমনিতেই বাড়িঘরে থাকতে পারছেন না। এরমধ্যে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে যাওয়া মানে নিশ্চিত গ্রেপ্তার হওয়া। নেতারা অনেকে দেশের বাইরে বসে কর্মসূচি দিয়েই দায় সারছেন। তাদের কাউকে মাঠে দেখা যাবে না, গ্রেপ্তার-নির্যাতনের শিকারও হতে হবে না। যা কিছু যাবে সব তৃণমূল কর্মীদের ওপর দিয়ে। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেবেন না বলেও জানিয়েছেন কেউ কেউ।
তৃণমূলের কর্মীরা বলেন, দলের সিনিয়র নেতারা আগে মাঠে নামুক, তারপর আমরাও নামব। আমরা আন্দোলন করে সুদিন ফিরিয়ে আনব, এরপর গায়েবি নেতারা এসে রাজত্ব করবে, কোটি কোটি টাকা কামাবে, সেটা আর হবে না।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রসঙ্গে আত্মগোপনে থাকা দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা কারণে দেশের মানুষ আজ অতিষ্ঠ। এই অবৈধ সরকারের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়। তাই মানুষকে রক্ষা করার জন্য, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আমরা এই কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছি।’
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমাদের এই লড়াই ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বরং জনতার শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জনগণের স্বার্থে, জনগণের দাবি আদায়ের জন্য এই আন্দোলন কর্মসূচি। এতে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ এই হরতাল-অবরোধ পালন করবে, কর্মসূচি সফল করতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও মাঠে থাকবে।