ক্ষমতাচ্যুত সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সত্য গোপন করেছে : জাতিসংঘের প্রতিবেদন

বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সরকার ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণবিক্ষোভের সময় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কোনো উদ্যোগই নেয়নি, বরং ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
গত বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতিসংঘ ‘জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) জানিয়েছে, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে সরকারি বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সহিংসতা তদন্তের কোনো বাস্তব প্রচেষ্টা দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হত্যার প্রমাণ মুছে ফেলতে পুলিশ কিছু নিহত ব্যক্তির মরদেহ পরিবারের কাছে ফেরত না দিয়ে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়, গোপন রাখে, এমনকি পুড়িয়েও ফেলে।
ওএইচসিএইচআর জানায়, পুলিশের বিশেষ শাখা এবং র্যাবকে গোপনে অতিরিক্ত গোলাবারুদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যাতে তাদের গুলিবর্ষণের হিসাব সরকারি নথিতে না আসে।
সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিবর্ষণ বা নির্যাতনের কোনো তদন্তই হয়নি। তৎকালীন কর্মকর্তারা দাবি করেন, ‘সংকটময় পরিস্থিতির’ কারণে কোনো ভুক্তভোগী আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেননি।
জাতিসংঘ বলেছে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনই তদন্ত শুরু করার জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে সরকার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা তো দূরের কথা, উল্টো সত্য গোপনের জন্য সমন্বিত চেষ্টা চালিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই, এনএসআই), পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল এমন বিভিন্ন হাসপাতালে উপস্থিত থেকে নির্যাতনের প্রমাণ লোপাট করতে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা নথি জব্দ করে।
নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতদের বিষয়ে জবাবদিহিতার দাবি জানানো আইনজীবী, সাংবাদিক, ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ কার হয়েছে।
‘বিভিন্ন আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ডিজিএফআই সদস্যরা ভুক্তভোগীদের পরিবার ও তাদের আইনজীবীদের ফোন করেছিল বা সরাসরি দেখা করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিল।’ বলে জানায় ওএইচসিএইচআর।
ওএইচসিএইচআর আরও জানায়, আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডে পুলিশের জড়িত থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও শত শত নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অথচ ভিডিও ফুটেজসহ অন্যান্য প্রমাণে স্পষ্ট ছিল যে পুলিশই তাকে হত্যা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বিএনপি ও জামায়াতের সদস্যদের বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও আহত করার জন্য দায়ী করেন, যদিও নিরাপত্তা বাহিনীই এসব কাজ করেছিল।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে দিয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমানে পলাতক থাকা তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তর্জাতিক নেতাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন, তবে এর জন্য ‘বিরোধী উসকানিদাতা’ ও ‘সন্ত্রাসীদের’ দায়ী করেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘এই তদন্তের আওতায় কেবল ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে সংঘটিত মৃত্যু, সহিংসতা, ধ্বংসযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতির’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, ‘যা কেবল বিক্ষোভকারীদের কর্মকাণ্ডের ওপর একতরফা দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, অথচ নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক সহিংসতা এড়িয়ে যাওয়া হয়।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্টের পর এই তদন্ত কমিটি কোনো অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনও প্রকাশ করেনি, এমনকি তাদের কার্যক্রমের কোনো লিখিত রেকর্ডও পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
কমিশন ৩০ জুলাই কেবল একটি অস্পষ্ট বিবৃতি দেয়, যেখানে ঘটনাকে ‘খুবই দুঃখজনক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলা হয় এবং গণগ্রেপ্তার না করার আহ্বান জানানো হয়।