‘অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন আর সমস্যা হয় না’

মনোয়ারা বেগমের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে। সেখানে তাঁর কোনো ঘর নেই। ভিটা নেই। জমিও নেই। নিজের থাকার কোনো জায়গা নেই। আবার অন্যের বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকতে মনোয়ারার ভালো লাগে না। সে জন্য চলে আসেন রাজধানীতে। কিন্তু ঢাকায় এসেও টাকার অভাবে কখনও বাসা ভাড়া করে থাকার সুযোগ হয়নি। থাকেন ফুটপাতে।
ষাটোর্ধ্ব মনোয়ারা বেগমের স্বামী রশিদ হোসেন মারা গেছেন ১২ বছর আগে। তার আগে আগুনে পুড়ে মারা যান তাঁর ছোট ছেলে মুকুল হোসেন। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন মুকুল। মুকুল মারা যাওয়ার আগেই প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান মনোয়ারা বেগম।
রশিদ হোসেনের দুই কাঠা ভিটে জমি ছিল। সেখানে একটি ঘর ছিল। মুকুলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে শেষ সম্বল হিসেবে থাকা জমিসহ ঘরটি বিক্রি করে দেন তিনি। এরপর থেকে তাদের আর থাকার জায়গা ছিল না। অন্যের বাড়িতে থাকতেন মনোয়ারা-রশিদরা। এভাবে কেটে যায় বছর দুয়েক। তারপর অসুস্থতায় মারা যান রশিদ হোসেন।
এরপর মনোয়ারা বেগম চলে আসেন ঢাকায়। রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে নিম্নমানের তরকারি কেনেন ভোরে। নিম্নমানের মানে পোকা লাগা, কিঞ্চিৎ খারাপ অথবা দেখতে ভালো না এমন ধরনের তরকারি। সেই তরকারি সকাল থেকে কারওয়ান বাজারেই বিক্রি করেন মনোয়ারা। প্রতিদিন গড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন। সারা দিনের খাওয়াসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে তেমন কিছুই থাকে না। তাই ঘর ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাঁর কখনো হয়নি। নারী হয়েও থাকতে বাধ্য হন রাজধানীর এই ফুটপাত, ওই ফুটপাতে।
গত সোমবার রাত ১২টায় দেখা যায়, মনোয়ারা বেগম রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মেট্রো স্টেশনের পাশের ফুটপাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। ফুটপাতে থাকা রেলিংয়ের এক পাশে মশারির দড়ি বেঁধেছেন। অন্য পাশে টানানোর জায়গা নেই। এ অবস্থায় তিনি মশারির মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরে একদল যুবক আসেন বিরিয়ানি নিয়ে। মনোয়ারা বেগমকে ডেকে তুলে বিরিয়ানি দিয়ে যুবকরা চলে যান। মূলত, সাহ্রী হিসেবে এ খাবার দিয়ে যান তারা।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। মনোয়ারা তাঁর জীবনের নানা গল্পের ঝুড়ি মেলে ধরেন।
মনোয়ারা বলেন, আগুনে পুড়ে ছেলে মারা যাওয়ার পর আমাদের আর কিছুই ছিল না। আমরা হয়ে যাই রাস্তার ফকির। চিকিৎসার জন্য জমি-ঘর সব বিক্রি করে দেয় মুকুলের বাবা। ঘুমানোর জায়গাও ছিল না আমাদের। আমার দুই মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়েছে। নাতি-নাতনিও আছে। মেয়ের জামাইরা খুব ভালো কাজ-কাম করে না। তাদের সংসারে অনেক টানাটানি। সে জন্য মেয়েদের বাড়ি কম যাওয়ার চেষ্টা করি। থাকিও না।’
মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ঢাকায় থাকি। তরকারি বিক্রি করি। তিন বেলা খেতে পারি। ওষুধ কিনতে হয় মাঝেমধ্যে। শরীর আর আগের মতো চলে না। দিনটা কোনোমতে চলে যায়। টাকা বেশি আয় করতে পারি না বলে বাসা ভাড়া নিতে পারি না। সে জন্য ফুটপাতে থাকি। তবে ঈদের আগে যাওয়ার দেশে (গ্রামে) চিন্তা করছি এবার। দুই মেয়ের বাড়ি ১০-১২ দিন থাকব। তারপর আবার চলে আসব। ঈদের পর আবার ফুটপাতে থাকতে হবে। অভ্যাস হয়ে গেছে, এখন আর সমস্যা হয় না।’
গ্রামে যাওয়ার আগে মনোয়ারা নাতি-নাতনিদের জন্য কম টাকা দিয়ে হলেও কিছু পোশাক কিনতে চান। ২৮ রমজানে তিনি নরসিংদী চলে যাবেন। বলেন, ‘নিজের জন্য কিছু কিনি আর না কিনি নাতি-নাতনিদের জন্য কিনতে হবে। অনেকদিন পর গ্রামে যাচ্ছি। ঈদটা করে ১০-১২ দিন পর আবার চলে আসব ঢাকায়।’

শুধু মনোয়ারা বেগম নয়, রাজধানীর ফুটপাতে থাকেন এমন অধিকাংশের ভাড়া বাসায় থাকার সামর্থ্য নেই। তাদের জীবনটাই কেটে যায় শহুরে ফুটপাতে।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে কাঁঠালবাগানের পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের পাশের ফুটপাতে আরেক নারীকে দেখা যায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে। সেখানকার এক চা দোকানি বলছিলেন, “এই নারী বহুদিন ধরে এখানে ঘুমান। গতকাল ওই নারী বলছিলেন, ‘মশার কামড়ে ঘুম হয় না। সে জন্য কম্বল গায়ে দিতে বাধ্য হই।’ ওই নারীর ভিক্ষা করেন। রাতে এসে এখানে ঘুমান।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মিন্তির কাজ করেন শরিফুল ইসলাম। তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে আছে যশোরের অভয়নগরে। সেখানে তারা পড়াশোনা করেন। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করানোর জন্য নিজের সুখশান্তি সব বিসর্জন দিয়েছেন তিনি। টাকা বাঁচাতে ফুটপাতে ঘুমান। সারাদিন যা কামান, নিজের বিকাশে রেখে দেন। অল্প কিছু টাকা নিজের কাছে রাখেন। কারণ, ফুটপাত থেকে প্রায়ই টাকা ও মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়।
শরিফুল বলেন, ‘মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠাই বাড়িতে। ছেলেটা ক্লাস সেভেনে পড়ে। মেয়েটা ক্লাস থ্রিতে। মিন্তির কাজ করি। মাঝেমধ্যে কারওয়ান বাজারের ট্রাক থেকে তরি-তরকারি নামিয়ে দিই। কিছু টাকা পাই। আর ঘুমাই কারওয়ান বাজারের আশপাশেই। কখনো রাস্তায় ঘুমাই। কখনো আবার কোনো আড়তের মধ্যে।’