আরাকানের যুদ্ধাবস্থা নিরসন করেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন : খলিলুর রহমান

আরাকানে বর্তমানে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, সেটার নিরসন না করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান। তবে সেই যুদ্ধাবস্থা পরিস্থিতি নিরসনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ড. খলিলুর রহমান এ মন্তব্য করেন।
গত ৩ থেকে ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য বৈঠক ও সফলতা নিয়ে কথা বলতে এই সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। এ সময়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপপ্রেসসচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর উপস্থিত ছিলেন।
খলিলুর রহমান বলেন, ‘বিমসটেক বৈঠকের ফাঁকে আমার সঙ্গে মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান শিউর আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একটা বড় অগ্রগতি হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমরা ছয়টি কিস্তিতে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছিলাম, সেখান থেকে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা তারা রিভিউ করেছে। তার মধ্য থেকে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে শনাক্ত করেছে, যারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। আর বাকি ৭০ হাজারের ছবি ও নাম নিয়ে কিছু কনফিউশন (বিভ্রান্তি) আছে। সেটা দূর করতে আমরা দুই পক্ষই আলোচনা চালিয়ে যাব। একইসাথে তারা বলেছে, বাকি পাঁচ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার রিভিউ দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করবে।’
কবে নাগাদ এই এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন শুরু হবে, জানতে চাইলে ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘তারা তো আর কালকেই চলে যাচ্ছে না। এটার জন্য একটি প্রক্রিয়া দরকার। যেকোনো প্রত্যাবাসনের একটি প্রক্রিয়া লাগে—তারা যাবে, কী করে যাবে, সেই জায়গাটা কী অবস্থায় আছে, নিরাপত্তা-সুরক্ষা আছে কি না এবং যাওয়ার জন্য জীবন-জীবিকার সংস্থান আছে কি না; কেবল রোহিঙ্গাদের বিষয়ে না, যেকোনো প্রত্যাবাসনে এই ধরনের বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে।’
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, ‘সব পক্ষের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখেছি। এই প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কাছ থেকে ভেরিফিকেশন নিতে হচ্ছে। ২০১৮ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি মোতাবেক এই ভেরিফিকেশন হয়েছে। মনে রাখতে হবে, রাখাইন এখনও মিয়ানমারের একটি সভরেন (সার্বভৌম) অঞ্চল। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়া, সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি আরাকান আর্মির সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া তাদের একটি প্রিন্সিপাল পজিশন, তারা এটা প্রকাশ্যে সেপ্টেম্বরে বলেছে। আমাদের সঙ্গে আলোচনার সময় দ্ব্যর্থহীনভাবে সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেছে।’ বলেন প্রধান উপদেষ্টার এই উচ্চপ্রতিনিধি।
সে কারণে আমরা মনে করি, এই এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারব মন্তব্য করে ড. খলিলুর রহমান বলেন, তবে সেটা কালকেই হচ্ছে না। তারা যাতে দ্রুততর সময়ে যেতে পারে, আমাদের সেই প্রচেষ্টা থাকবে। সে কারণে মিয়ানমার, আরাকানের বাস্তব কর্তৃপক্ষ, জাতিসংঘ ও আমাদের বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে মিলে আমরা কাজটি করব।
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন—আগামী ঈদ যাতে রোহিঙ্গারা তাদের দেশে গিয়ে করতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য।’
রোহিঙ্গারা যেখানে ফিরবেন, সেখানকার ৮০ শতাংশ এলাকা আরাকান আর্মির অধীন। তাদের দেশের মধ্যকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করবে কি না, প্রশ্নে ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘গত তিন মাসে আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছি। প্রথম কথা হচ্ছে, বিষয়টি (রোহিঙ্গা) মানুষ ভুলেই যাচ্ছিল। জাতিসংঘের মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা গিয়ে বিষয়টি তোলেন। শুধু তা-ই না, জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে, সেই সিদ্ধান্ত তিনি আদায় করে নিয়ে এলেন।’
গত ১৫ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থীশিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেছেন।
খলিলুর রহমান বলেন, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছেন, প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান। আমরা গেলাম চীনে, সেখানকার যৌথ বিবৃতিতেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন একমাত্র সমাধান বলা হয়েছে। এই যে এই প্রত্যাবাসন ইস্যু হয়েছে। আর কোনো ইস্যু নেই। এ ছাড়া প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আমরা প্রথমবারের মতো একটি সংখ্যা পেলাম। গেল আট বছরে এই সংখ্যাটা আমাদের কাছে ছিল না। এই প্রথম একটি অ্যাগ্রিড সংখ্যা আমরা পেলাম। আমাদের একটি ভিত্তি হলো। এখন কথা হচ্ছে, আপনি তো একটি জনগোষ্ঠীকে আগুনের মধ্যে ঠেলে দিতে পারেন না। তার নিরাপত্তা আপনাদের দেখতে হবে। সেখানে গিয়ে তারা যাতে জীবনযাত্রা শুরু করতে পারে, তার একটি এনবলিং এনভাইরনমেন্ট নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। এটা আমরা একা পারব না, সবার সঙ্গে আলাপ করে করতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে আমরা এই কাজ করছি না।’
আরাকানে স্থিতিশীলতা ফেরাতে কাজ করছে বাংলাদেশ
আরাকানে স্থিতিশীলতা ফেরাতে বাংলাদেশ কাজ করছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার উচ্চপ্রতিনিধি বলেন, ‘আরাকানে যাতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দ্রুত ফিরে আসে, সেখানকার মানবিক সংকট, সেটা নিরসনে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কাজ করছি। যত দ্রুত সম্ভব, আমরা চেষ্টা করছি, সেখানকার হিউম্যানিটারিয়ান সিচ্যুয়েশন যাতে আমরা কিছুটা হলেও নিরসন করতে পারি। সে জন্য দরকার বিবদমান দুই পক্ষের যুদ্ধের বিরতি।’
ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি বলতে পারি, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে যে হিউম্যানিটারিয়ান সাপোর্ট জাতিসংঘ যেমন দেবে, যেটাতে আমরা সাহায্য করব—সেই সময়টাতে দুই পক্ষ যুদ্ধাবস্থা পরিহার করবে।’
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, ‘সেখান থেকে একটি স্থিতির সূচনা হবে বলে আমরা আশা করছি। সেই মুহূর্তটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। খুব বেশি দেরি নেই সেটার। সেই সময় থেকে আমরা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একটা বাস্তব আলোচনা করতে পারব।’
জাতিসংঘের মহসচিব এখানে একটি একটি আন্তর্জাতিক হিউম্যানিটারিয়ান করিডোরের কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী, প্রশ্নে ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘করিডর কথাটি তিনি বলেননি, চ্যানেল বলেছেন। করিডরের একটি আইনগত মানে আছে, যে কারণে তিনি এটি অ্যাভয়েড করেছেন। আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই তিনি এটা বলেছেন। আমি যখন তার সঙ্গে ৭ ফেব্রুয়ারি দেখা করতে গেলাম, আমাদের পরিকল্পনা—মিয়ানমার, আরাকান আর্মি কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থা—সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই আমি জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে গিয়েছি। রাখাইনে যে মানবিক সমস্যা ও সংকট—সেটা মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের বিকল্প নেই। সেই কাজটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানেই হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র কনড্যুয়িট বা চ্যানেল, যার মাধ্যমে এটা করা সম্ভব।’
ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘কারণ রাখাইনের উপকূল এখনও তাতমাদোর দখলে। অন্যান্য জায়গা দিয়ে সহজে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব না। আমরা কাজটি এই জনগোষ্ঠীর জন্য করতে চাচ্ছি এই কারণে যে, সব মানুষই কিন্তু মানুষ। রাখাইনরা নির্যাতিত হয়েছে, সেটা যেমন খুবই পরিতাপের বিষয়, তেমনই রাখাইন সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন না-খেয়ে আছে, ওষুধপত্র পাচ্ছে না, এই যুদ্ধে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এই যুদ্ধে দুই সম্প্রদায়ের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কাজেই যতটুকু সম্ভব দুই পক্ষকে সাহায্য দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এটা কেবল আমাদের না, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দায়িত্ব। আগামী দিনগুলোতে আমাদের চেষ্টার কোনো ঘাটতি থাকবে না এ ক্ষেত্রে।’
রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ কাজ করছে বলে যে কথা বলেছেন, এটা কতদূর এগিয়েছে, জানতে চাইলে ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘গেল আট বছরে আমরা অনেক কাজ করিনি। পুরো জিনিসটা একটা ইন্টিগ্রিটেড ইউনিট বলে ধরে নিতে পারেন। আমরা একটা একটা বেছে বেছে করতে পারব না। পুরো জিনিসটা দেখতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সঙ্গে আরাকানের শান্তিশৃঙ্খলা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শান্তিময় পরিবেশ না হলে একটা যুদ্ধের মধ্যে কাউকে (রোহিঙ্গা) ঠেলে দিতে পারেন না। আমরা বলে আসছি, স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের কথা। আমরা কাউকে ঠেলে দেব না। যাওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে। এটা জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার কক্সবাজার সফরের সময় দেখেছেন, তারা কীভাবে সাড়া দিয়েছেন।’
ড. খলিলুর রহমান আরও বলেন, ‘মহাসচিব নিজে উদ্যোগ নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনারা কী যেতে চাচ্ছেন? তারা সবাই যেতে চেয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। কিন্তু এই যাওয়াটা যাতে স্বেচ্ছায় হয়। বর্তমানে যুদ্ধাবস্থা কিংবা স্থিতির অভাব আছে, সেটার নিরসন না করে হচ্ছে না। সেই কাজটা আমাদের করতে হবে। আমরা একাই করছি না, সবাই আমাদের সঙ্গে আছেন। এই ডাইমেনশনটা আগে ছিল না। অনেক ডাইমেনশনই ছিল না।