সেনবাগ আওয়ামী লীগনেতাদের চোখে মোরশেদ আলম যেমন

‘উড়ি আই জুড়ি বইছে (উড়ে এসে জুড়ে বসেছে), হেতেরে (তাকে) সেনবাগের কে চিনতো, নেত্রী (শেখ হাসিনা) নমিনেশন দিছে (দিয়েছে), আমরা তারে চিনাইসি (চিনিয়েছি)।’ আঞ্চলিক ভাষায় নোয়াখালী-২ (সেনবাগ-সোনাইমুড়ী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলমকে নিয়ে ঠিক এভাবেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লিগের সাবেক সভাপতি জাফর আহমেদ চৌধুরী।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্য সব সংসদ সদস্যের মতো আত্মগোপনে চলে যান মোরশেদ আলমও। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। গত মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) রাতে তাকে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ধানমণ্ডি এলাকায় কিশোর মো. শামীম হত্যা মামলায় বুধবার (৯ এপ্রিল) তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজনীতির মাঠে একবারেই অপরিচিত মুখ ছিলেন মোরশেদ আলম। কথিত আছে, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অভিষেক হয় তার। সেবার কয়েক’শ কোটি টাকার বিনিময়ে নোয়াখালী-২ আসনে নৌকা প্রতীকের নমিনেশন কিনে নেন তিনি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটবিহীন ওই নির্বাচনে বাজিমাত হয় তার। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও আসনটি থেকে সংসদ সদস্য হন তিনি।
ওই আসনে ২০০৮ সালে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ। বিএনপিনেতা জয়নুল আবদিন ফারুকের কাছে হেরে যান তিনি। এতে ২০১৪ সালে আর দলটি জামাল উদ্দিনের উপর আস্থা রাখতে পারেনি। সেই সুযোগেই দলীয় টিকিট বাগিয়ে নেন মোরশেদ আলম।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, ‘ও বদমাইশ, টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনেছে, আমি রাজনীতি করে নমিনেশন পেয়েছিলাম। সে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে (ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি) প্রতি বছর ৬০ কোটি টাকা করে দিয়ে ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হয়।’
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই নেতা আরও বলেন, ‘সে (মোরশেদ আলম) সেনবাগকে নষ্ট করেছে, সেনবাগের আওয়ামী লীগকে নষ্ট করেছে। এর জন্য অবশ্য আওয়ামী লীগই দায়ী। দল তাকে নমিনেশন না দিলে, নির্বাচনে প্রার্থী না বানালে সে কখনো এখানে রাজনীতির সুযোগ পেত না। সেনবাগে এসেই দলটাকে কয়েকটা গ্রুপে বিভক্ত করে ফেলেছে। টাকা দিয়ে দিয়ে ছেলে-পেলেদের মাথা নষ্ট করেছে।’
‘মোরশেদ আলম আমাকে অনেক অপমান করেছে, আমাকে নানাভাবে আটকানোর চেষ্টা করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দিয়ে আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল কিন্তু পারে নাই। আমাকে সে নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতো সেনবাগের’- যোগ করেন ড. জামাল উদ্দিন।

সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই দলটির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। মোরশেদ আলমের কারণে ভাটা পড়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে। তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ দিন ছিলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, আমাকে সরিয়ে নিজেই সভাপতি হয়ে গেলেন মোরশেদ আলম। কোনো ভোট বা সম্মেলন ছাড়াই নিজেকে নিজে সভাপতি ঘোষণা করেন। আমি ছিলাম নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, কিন্তু ২০২৪-এর নির্বাচনে তিনি এখানেও আমাকে সরিয়ে তার ছেলে সাইফুল ইসলাম দিপুকে প্রার্থী বানান, জোর করে ছেলেকে চেয়ারম্যান বানান।’
‘মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা বরাবর আমরা চিঠিও দিয়েছিলাম। যেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতার স্বাক্ষর ছিল। ওই চিঠির একটি কপি দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনকে (চট্টগ্রাম বিভাগীয় আওয়ামী লীগনেতা) দিয়েছি। তার দ্বারা সেনবাগের সব আওয়ামী লীগনেতাই নানাভাবে অপমানিত হয়েছেন।’ বলেন জাফর আহমেদ।
জাফর আহমেদ আরও বলেন, ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, মোরশেদ আলমকে সেনবাগের কে চিনতো? নেত্রী নমিনেশন দিয়েছেন, আমরা তাকে চিনিয়েছি। আমি-জামাল সাহেব (ড. জামাল উদ্দিন) তাকে নির্বাচনে সহযোগিতা করেছি। কিন্তু তিনি তৃণমূলের নেতাদের মূল্যায়ন করতেন না। সেনবাগে উনিই সব ছিলেন, উনি এমপি, উনি সভাপতি, ওনার ছেলে চেয়ারম্যান, সব ওনার।’
মোরশেদ আলমকে কারাগারে পাঠানো প্রসঙ্গে জাফর আহমেদ বলেন, ‘শুনেছি তাকে হত্যা মামলায় আটক করেছে। তার বিচার হওয়া উচিত। অপরাধী হলে তো অবশ্যই বিচার হবে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে ক্ষমা করে দিলাম।’
সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লিগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার সাবেক মেয়র আবু জাফর টিপুর সঙ্গে মোরশেদ আলমের ইস্যুতে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আর রাজনীতি করব না, আমার ক্ষতি করেছে। যেহেতু আর রাজনীতি করব না, তাই তার নাম বলব না (মোরশেদ আলম), তাকে নিয়ে কথা বলব না।’
সাবেক মেয়র টিপু আরও বলেন, ‘এই আওয়ামী লীগের রাজনীতির কারণে আমার সব শেষ। নিজের জায়গা হলে হতো, বাবার দেওয়া জমি বিক্রি করে তাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছি। নামাজের বিছানায় বসে মিথ্যা বলছি না। এখন আমার প্রচুর টাকা ঋণ, এই ঋণ পরিশোধ করে কোনো রকম জীবনটা পার করে দিতে চাই। আমার কোনো আক্ষেপ নেই, কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।’
স্থানীয় অনেক নেতা-কর্মীই মোরশেদ আলমের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তার কারণে জোরপূর্বক ভোট প্রদান, এলাকা শক্তি প্রদর্শনসহ নানা কারণেই তারা এখন বিতকির্ত। গ্রেপ্তার আতঙ্কও বিরাজ করছে অনেকের মধ্যে।