অশ্রুসিক্ত লাখো চোখ, ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহ্বান

ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি বর্বরতা ও গণহত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে গাজায় আগ্রাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নিতে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া ইসরায়েল ও ইসরায়েলিদের যারা সহযোগিতা করে তাদের সকল পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হয়।
পরে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি কামনায় কর্মসূচিতে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাতে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের চোখে ছিল অশ্রু। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, শিশু ও নারীদের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকার করুণ বাস্তবতা হৃদয়ে নিয়ে মানুষ প্রার্থনা করেন শান্তির জন্য।
আজ শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেল সোয়া ৩টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। এরপর সমাবেশে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।

ঘোষণাপত্রে গাজায় আগ্রাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নিতে এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
মাহমুদুর রহমান ঘোষণাপত্রে তিনভাগে দাবি উত্থাপন করেন। প্রথম ভাগে জাতিসংঘ, দ্বিতীয় ভাগে ওআইসিসহ মুসলিম বিশ্ব এবং তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি উত্থাপন করা হয়।
মোনাজাতে বলা হয়, ইসরায়েল ফিলিস্তিনে যে নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা মানবতার ওপর চরম আঘাত। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যেন তিনি নির্যাতিত মুসলমানদের রক্ষা করেন এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতার আলো দেখান।
একইসঙ্গে মোনাজাতে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হওয়া, ধ্বংসস্তূপে আটকেপড়াদের উদ্ধার ও আহতদের সুস্থতা, শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের জীবন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ, বিশ্ব নেতাদের বিবেক জাগ্রত হওয়া, নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত আগ্রাসনের বিচার চেয়ে দোয়া করা হয়।
মোনাজাতে অংশ নেওয়া মো. শাহজাহান নামে এক বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, টেলিভিশনে ছোট ছোট শিশুদের লাশ দেখে ঘুম আসে না। আজ মোনাজাতে শুধু একটাই কথা বলেছি যে, হে আল্লাহ, ফিলিস্তিনকে রক্ষা করো।
ঘোষণাপত্রের প্রথম ভাগে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, আর্ন্তজাতিক ব্যর্থতার কারণে বিশ্ব মজলুম ফিলিস্তিনিদের পাশে না দাঁড়িয়ে দখলদার ইসরায়েলকে রক্ষায় মেতে উঠেছে। তাই জাতিসংঘকে জায়নবাদী ইসরায়েলের বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে করতে হবে। যুদ্ধবিরতি নয় বরং গণহত্যা বন্ধে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। এছাড়া ১৯৬৭ সালের পূর্বের ভূমি ফিরিয়ে দিতে ইসরায়েললকে বাধ্য করতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে।

ঘোষণাপত্রের দ্বিতীয় ভাগের দাবিতে ওআইসিসহ মুসলিম বিশ্বের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, ফিলিস্তিনে যে বর্বরতা হয়েছে তা মুসলিম বিশ্বের ব্যর্থতার অংশ। জায়নবাদীরা শুধু ফিলিস্তিনে নয় আমাদের এ অঞ্চলেও ভারতের হিন্দুত্ববাদের মাধ্যমে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছে। ভারত সম্প্রতি পাস হওয়া ওয়াকফ আইনের মাধ্যমে এ ধরনের সম্পত্তিতে হিন্দুদের প্রতিনিধি রেখে মুসলিমদের সম্পত্তি দখলে মেতে উঠেছে। তাই ওআইসিসহ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের আহ্বান- ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক সর্ম্পক ছিন্ন করতে হবে। জায়নবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। গাজার মানুষদের মাঝে চিকিৎসা সামগ্রী, খাদ্য, বস্ত্রসহ সকল সহযোগিতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে ইসরায়েলকে একঘরে করতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। জায়নবাদের দোসর ভারতে হিন্দুত্ববাদ আজ এই অঞ্চলে জায়নবাদী প্রকল্পের প্রতিবিম্বে পরিণত হয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত দমন-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে বলা হয়, পাসপোর্টে ‘একসেপ্ট’ শব্দ পুনর্বহাল করতে হবে। ইসরায়েলের সঙ্গে সব সর্ম্পক ছিন্ন করতে হবে। গাজায় ত্রাণ সামগ্রীসহ চিকিৎসাসেবা দল পাঠাতে হবে। জায়নবাদের দোসর ভারতে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। পাঠ্যবইয়ে শিক্ষানীতিতে আল আকসা মসজিদসহ ফিলিস্তিনের ইতিহাস অর্ন্তভুক্ত করতে হবে। ইসরায়েল ও ইসরায়েলিদের যারা সহযোগিতা করে তাদের সকল পণ্য বর্জন করতে হবে।
এ সময় মাহমুদুর রহমান বলেন, ভারতে সম্প্রতি ওয়াকফ সম্পত্তি আইন সংশোধনের মাধ্যমে মুসলিমদের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্বত্বাধিকার হরণ করা হয়েছে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি স্পষ্ট সতর্কবার্তা।
মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জনতা, যারা জুলুমের ইতিহাস জানি, প্রতিবাদের চেতনা ধারণ করি, সমবেত হয়েছি গাজার শহীদদের পাশে দাঁড়াতে। আজকের এই সমাবেশ কেবল প্রতিবাদ নয়, এটি ইতিহাসের সামনে দেওয়া আমাদের জবাব, একটি অঙ্গীকার, একটি শপথ।
মাহমুদুর রহমান আরও বলেন, আমরা দেখেছি, গাজায় প্রতিদিন যে রক্তপাত, যে ধ্বংস চলছে, তা কোনো একক সরকারের ব্যর্থতা নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ব্যর্থতার ফল।
পরে অনুষ্ঠানের সভাপতি বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা আবদুল মালেকের মোনাজাতের মধ্য দিয়ে আয়োজন শেষ করা হয়।
এর আগে, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
সমাবেশে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, হেফাজতে ইসলাম, আহলে হাদীস, হাইয়াতুল উলইয়া, বেফাকুল মাদারিস, দারুন্নাজাত মাদরাসা, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলনের নেতারা অংশ নেন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামারা।
এ যেন এক টুকরো ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের পতাকা ও ফিলিস্তিনের মুক্তির স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। এ যেন এক টুকরো ফিলিস্তিন! নারী-পুরুষ-শিশুদের পদচারণায় সোহরাওয়াদী উদ্যানসহ এর আশপাশের এলাকায় তিল পরিমাণ ঠাঁই ছিল না।
সকাল থেকে রাজধানীর শনিরআখড়া-যাত্রবাড়ী রুট, টঙ্গী, উত্তরা, কেরানীগঞ্জ, গাবতলী, শ্যামলী দিয়ে বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে এবং মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় আসতে শুরু করেন লাখো মানুষ। দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর মোড় থেকে নারী-পুরুষের স্রোত যায় সোহরাওয়াদী উদ্যানের দিকে।
মিছিলের সম্মুখে কাপড়ে মোড়ানো কয়েকটি লাশের প্রতিকৃতি নিয়ে তারা সোহরাওয়ার্দীর অভিমুখে যাচ্ছিলেন। সে সময় তাদের ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন; ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
এ ছাড়া ইসরায়েলের পণ্য, বয়কট বয়কট; ট্রাম্পের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে; ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও, ইসরাইলের আস্তানা; নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবরসহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা গেছে। রাজধানীর শাহবাগে যেন জনসমুদ্র। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত গোটা শাহবাগ।