ফিলিপাইন আখ চাষে বিপ্লব ঘটালেন মহসিন

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফিলিপাইন জাতের আখ ‘ব্ল্যাক সুগার কেইন’ চাষ করে নজিরবিহীন সফলতা পেয়েছেন মহসিন আলী প্রামাণিক (৩৩)। স্থানীয়ভাবে ‘কুসার’ নামে পরিচিত এই আখের কাণ্ড অত্যন্ত নরম, রসে ভরপুর এবং অতিমাত্রায় মিষ্টি, যা বাজারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে।
উপজেলার পুনট ইউনিয়নের পাঁচগ্রামের বাসিন্দা শামসুল আলমের ছেলে মহসিন আলী প্রামাণিক তিন বছর আগে ইউটিউব দেখে প্রথম এই আখ চাষে আগ্রহী হন। এরপর বগুড়া থেকে চারা সংগ্রহ করে এক বিঘা জমিতে চাষ শুরু করেন। এলাকার লোকজন প্রথমে নানা কটূক্তি করলেও তিনি থেমে থাকেননি। ফলও মিলেছে দারুণ।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি সাইফুল প্রামাণিক বলেন, মহসিন আমাদের গ্রামের ছেলে। আমাদের গ্রামে এখন আখ চাষ হচ্ছে। এই আখ খুবই মিষ্টি ও ভালো।
কৃষক ছবির সরদার বলেন, আমাদের এলাকায় সাধারণত আলু আর ধান বেশি আবাদ হয়। তারপরেও আমাদের গ্রামের ছেলে ব্যতিক্রম হিসেবে আখ আবাদ করেছে। তিনি অনেক লাভবান হয়েছেন। তার এই সাফল্য সবাই প্রশংসা করেছেন।
গ্রামের আরেক ব্যক্তি গফুর সরদার জানান, আমাদের এলাকায় ধান-আলু চাষেই মানুষ বেশি মনোযোগী। এর পাশাপাশি মহসিন আখ চাষ করেছে। এবার মহসিনের দেখাদেখি এই গ্রামে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে আখ চাষ হচ্ছে।
আইয়ুব প্রামাণিক বলেন, মহসিন ভাই ৫০ শতক জমিতে আখ লাগিয়ে খুব লাভবান হয়েছেন। তার এই লাভবান হওয়ার খবর দেখে গ্রামের অনেক যুবক আখ চাষে আগ্রহী হচ্ছে।
আখ দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা কৃষক ফজলু ফকির বলেন, মহসিন প্রথম অবস্থায় ১ বিঘা জমিতে আখ চাষ শুরু করেছিল প্রায় দুই বছর আগে। শুরুতে অনেকেই তাকে কটূ কথা বলেছিল, উপহাস করেছিল। কিন্তু এখন তার সফলতা দেখে অনেকে আগ্রহী হচ্ছে। এখান থেকে আমাদের একটা কর্মসংস্থানও হয়েছে। আশা করি এরকম আরও উদ্যোক্তা গড়ে উঠবে।
একই গ্রামের উদ্যোক্তা মান্নান আকন বলেন, ও আমাদের গ্রামের ছেলে। আখ চাষ করে তিনি অনেক উন্নয়ন করেছেন। আমরা নিজেরাও তার মতো উন্নতি করার জন্য আখ চাষে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আখ চাষে আগ্রহী পার্শ্ববর্তী সড়াইল গ্রামের জাহেরুল ইসলাম বলেন, মহসিন ভাইয়ের আখ চাষের কথা শুনে দেখতে এসেছি। দেখে অনেক ভালো লাগলো। আমিও চেষ্টা করবো এইভাবে আখ চাষ করার জন্য।
গ্রামের নবীন উদ্যোক্তা মো. মারুফ বলেন, মহসিন ভাই আমাদের এখানে সর্বপ্রথম ফিলিপাইন আখ চাষ শুরু করেছিলেন। তার চাষ দেখে আমরা প্রথমে হাসাহাসি করেছি, নানা কথা বলেছি। পরে তার সাফল্য দেখে আমি নিজেও উদ্বুদ্ধ হয়ে আখ চাষ শুরু করি। আমিও এতে সফলতা পেয়েছি।
এ বিষয়ে ফিলিপাইন জাতের আখ চাষে সফল উদ্যোক্তা মহসিন আলী বলেন, ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখে ফিলিপাইন আখ চাষে আগ্রহী হই। প্রথম বছরে ৪০ শতাংশ জমিতে ১ লাখ টাকা খরচ করে প্রায় ৫ লাখ টাকার আখ বিক্রি করি। দ্বিতীয় বছরে ৫৫ শতাংশ জমিতে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা খরচ করে চারা ও আখ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকার বিক্রি হয়।

মহসিন আলী আরও বলেন, এ বছর ৭৫ শতাংশ জমিতে আখ চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, আর হয়তো ৫০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। সে হিসেবে মোট খরচ দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ টাকা। বর্তমানে প্রতি পিস আখ ৫০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। জমিতে যে পরিমাণ আখ আছে, তাতে ধারণা করছি এ বছর প্রায় ১৫ লাখ টাকার আখ বিক্রি হবে।
মহসিন আলী বলেন, আখ বিক্রির পাশাপাশি আমি চারাও তৈরি করছি। এই চারাগুলোর চাহিদা খুব বেশি। বাজারে প্রতি পিস চারা ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকেও বাড়তি আয় হচ্ছে। মাত্র দুদিন আগে ২০ হাজার আখের চারার অর্ডার পেয়েছি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকেই ফোন করে চারা নিতে চাইছে। আমার এ সফলতা দেখে এখন এলাকার অনেকেই এই আখ চাষে উৎসাহিত হচ্ছে। এ বছর আমাদের পাঁচগ্রামে প্রায় ২০ বিঘা জমিতে ফিলিপাইন আখ চাষ হয়েছে।
কালাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অরুণ চন্দ্র রায় বলেন, কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নে সর্বপ্রথম ফিলিপাইন জাতের আখ চাষ শুরু হয়। তখন থেকেই তরুণ উদ্যোক্তা মহসিনকে আমরা নিয়মিত পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি।

অরুণ চন্দ্র রায় আরও বলেন, ফিলিপাইন জাতের আখ চাষে যে ধরনের টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন, তা আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করছি। মাঠ পর্যায়ে আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারাও সরাসরি এ বিষয়ে সহায়তা দিচ্ছেন। মহসিনের সফলতা দেখে এখন উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়ন ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার অনেক কৃষক এই আখ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।