মেঘনায় দূষণ চরমে, ফের মরে ভেসে উঠছে মাছ

চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে অব্যাহত বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি মিশে দূষণের ফলে আবারও হুমকির মুখে পড়েছে নদীর জীববৈচিত্র্য। ইতোমধ্যে নদীর দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে উঠতে শুরু করেছে। মরা মাছের গন্ধে নদী তীরবর্তী এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
এর আগে এ বছরের জানুয়ারিতেও একবার পানি দূষণের বলি হয় মেঘনার জীববৈচিত্র্য। ওই ঘটনার তদন্ত করে চাঁদপুরের পরিবেশ অধিদপ্তর। আবারও মাছ মারা যাওয়ার বিষয়ে তদন্ত হবে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সূত্র।
গতকাল শুক্রবার (১৬ মে) ভোর থেকে জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে দশানি পর্যন্ত মেঘনা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে মাছ মরে ভেসে থাকতে দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে নদীপাড়ের মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
গতকাল ভোরে মাছ ধরতে নদীতে নামেন স্থানীয় জেলেরা। তখনই তারা দেখতে পান, পানিতে ভেসে রয়েছে অসংখ্য মরা মাছ। বিশেষ করে জাটকা, চেউয়া, বেলে, টেংরা, পুঁটি, চাপিলাসহ অসংখ্য ছোট-বড় দেশীয় মাছ মারা যাচ্ছে।
পঁচা মাছের দুর্গন্ধে নদীপাড়ের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। দূষণের কারণে এখন নদীর পানি খাওয়াতো দূর, সাধারণ গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করতে পারছে না স্থানীয়রা। কী কারণে বারবার নদীর মাছ মারা যাচ্ছে এবং পানি দূষণ হচ্ছে, এ বিষয়ে দ্রুত সমাধান চান এলাকাবাসী।
এদিকে ইলিশের পোনা জাটকা মরে ভেসে ওঠায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন মেঘনাপাড়ের জেলেরা। এভাবে ছোট ছোট জাটকা মারা পড়লে চলতি মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে জেলেদের মাঝে।
মতলব উত্তরের ষাটনল এলাকার জেলে পলাশ বর্মন ও তার ভাই বলেন, ‘এই নদীই আমাদের জীবন। কিন্তু এখন এই পানিতে মাছতো নেই বরং বিষ ছড়িয়ে গেছে। গত কয়েক বছর ধরেই এমনটি হচ্ছে। কেউ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। জাটকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মাছশূন্য হয়ে পড়বে নদী।’

দশানি এলাকার বাসিন্দা সেলিনা বেগম বলেন, ‘বাচ্চারা নদীতে খেলতে যায়, গোসল করে। এখন তো মনে হচ্ছে, পানিতে হাত দিলেও অসুস্থ হয়ে যাবে, খোস-পাঁচড়া হবে। আমরা নদীর পানি সব সময় ব্যবহার করি, পানও করি; কিন্তু এখন পারছি না।’
দশানি এলাকার মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে যা দেখলাম, তাতে আগামী কয়েক মাস নদী থেকে মাছ পাওয়া কঠিন হবে। বাজারে মাছের দাম বেড়ে যাবে এবং ভুক্তভোগী হবে স্থানীয় লোকজন।’
পার্শ্ববর্তী কলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘যেসব এলাকায় মাছ মরে যাচ্ছে, ওই এলাকা পরিদর্শন করেছি। নদীর এই অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। মাছ মরার এই ঘটনা শুধু পরিবেশের ক্ষতি নয়, মানুষের জীবন-জীবিকার ওপরও সরাসরি আঘাত।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন শত শত মানুষ এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। বারবার অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমি উপজেলা পরিষদে বিষয়টি তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জেলা প্রশাসনের কাছেও লিখিত অভিযোগ পাঠাব। নদী বাঁচলে আমরা বাঁচব—এটাই এখন সবার মূল দাবি হওয়া উচিত।’
মতলব উত্তর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, ‘এটি নিছক মাছ মরার ঘটনা নয়। এটি একটি জলজ পরিবেশগত দুর্যোগ। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা থেকে আসা দূষিত পানির প্রবাহ একাধিকবার এই এলাকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এটি প্রথম নয়, একাধিকবার ঘটেছে এমন ঘটনা।’
তিনি জানান, ২০২৩ সালের মার্চ ও ২০২৪ সালের আগস্ট মাসেও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। তখনও মেঘনার পানি দূষিত হয়ে মাছের গণমৃত্যু হয়। তবে এবার পরিমাণ আরও বেশি দেখা যাচ্ছে।
পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠন ‘মতলবের মাটি ও মানুষ’-এর সভাপতি শামীম খান বলেন, নদীকে কেন্দ্র করে হাজারো পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। বারবার দূষণে নদী মৃতপ্রায়, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
তিনি বলেন, প্রয়োজন দ্রুত আন্তঃজেলা পরিবেশ কমিশন গঠন এবং কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানবিক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও হচ্ছে এই ঘটনায়। এতে শুধু পরিবেশ নয়, শত শত জেলে ও মাছ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। নদীর ওপর নির্ভরশীল হাজারো মানুষের জীবিকা এখন হুমকির মুখে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, মেঘনা নদীতে মাছ মরে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। সেখানকার প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, নদীর পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পিএইচ ও অক্সিজেনের হার কমে গিয়েছিল। এছাড়া নদীর তলদেশ দিয়ে কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ও কেমিক্যালযুক্ত পানি বয়ে যাওয়াও একটি বড় কারণ।
তিনি আরও বলেন, নতুন করে আবার কেন মাছ মারা যাচ্ছে, সেটি তদন্ত করে দেখতে হবে। তবে আবারো নদীতে মাছ মারা যাওয়ার খবর এখনো কেউ জানায়নি। ঘটনাস্থলে গিয়ে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।