বাংলাদেশের পক্ষে আরও বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয় : প্রেস উইং

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার সর্বশেষ অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ বিষয়ে প্রশ্নোত্তর আকারে একটি ব্যাখ্যা আজ বুধবার (২১ মে) গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুতি ও প্রত্যাবাসন সংকট সমাধানে সরকার একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে জানিয়েছে সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষে আর বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার নিয়ে প্রস্তাবের বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রশ্ন : রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থান কী?
উত্তর : রাখাইন রাজ্যে তীব্র মানবিক সংকটের কারণে সেখানে মানবিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। ইউএনডিপির পূর্বাভাস অনুযায়ী, সেখানে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ আশঙ্কা করছে যে, এমন পরিস্থিতি রাখাইন থেকে আরও মানুষকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করবে। ইতোমধ্যেই মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে আরও বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় বোঝায় পরিণত হয়েছে।
রাখাইন রাজ্যের মানবিক সংকট বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ মানবিক সহায়তা প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করতে শুরু করে। যেহেতু সংঘাতের কারণে সাহায্য সরবরাহের অন্যান্য সকল পথ বর্তমানে অকার্যকর, তাই বাংলাদেশই এখন একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প। প্রাথমিকভাবে চিন্তা করা হয়েছিল যে জাতিসংঘ তার চ্যানেলের মাধ্যমে রাখাইনে সহায়তা বিতরণের ব্যবস্থা করবে এবং মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা প্রদান করবে।
এ ছাড়া, বাংলাদেশ মনে করে যে রাখাইনে সাহায্য প্রদান রাজ্যটিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির পথ প্রশস্ত করবে।
রাখাইনে সাহায্য প্রদানের ব্যাপারে এখনো কোনো চুক্তি হয়নি কারণ এর জন্য সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সম্মতি এবং সহায়তা প্রদানের জন্য বেশকিছু পূর্বশর্ত পূরণের প্রয়োজন যা বিশ্বের সবখানেই মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে একইভাবে পূরণযোগ্য। এর মধ্যে রয়েছে, সহায়তা প্রদানকারী এবং গ্রহীতাদের নিরবিচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার, সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা, সহায়তাকে সামরিক উদ্দেশে ব্যবহার না করা এবং সশস্ত্র কার্যকলাপ স্থগিত রাখা।
প্রশ্ন : আরাকান বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের কারণ, সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না?
উত্তর : আরাকান সশস্ত্র বাহিনী যখন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় তখন বাংলাদেশ সরকার তাদের সাথে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। নিজ সীমান্ত রক্ষা এবং শান্তিপূর্ণ রাখা বাংলাদেশের কর্তব্য। এ কারণেই, বাংলাদেশ আরাকান সেনাবাহিনীর সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশ সরকার রাখাইনে মানবিক সহায়তা প্রদান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং আরাকানের শাসনব্যবস্থা ও নিরাপত্তা কাঠামোর সকল স্তরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার স্বার্থে আরাকান বাহিনীর সাথে যোগাযোগ রেখেছে।
বাস্তবিক প্রয়োজনেই আরাকান বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের এই যোগাযোগ। একইসঙ্গে, মিয়ানমার সরকারের সাথেও যোগাযোগ বজায় রাখছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকট টেকসইভাবে সমাধানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশি কর্মকর্তারা সম্প্রতি বলেছেন যে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার প্রস্তাবে বাংলাদেশের সম্মতির জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। সেই শর্তগুলো কী কী এবং এই বিষয়ে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না?
উত্তর : প্রথম কথা হলো, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সহায়তা প্রদানের বিষয়ে একমত হতে হবে। পাশাপাশি আরাকান বাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে যে সহায়তা প্রদানকারী এবং গ্রহীতাদের প্রবেশাধিকার যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সহায়তাকে সামরিক উদ্দেশে যেন ব্যবহার না করা হয় এবং কোনো সশস্ত্র কার্যকলাপ যেন না ঘটে।
আরাকান বাহিনী রাখাইনের শাসনব্যবস্থা ও নিরাপত্তা কাঠামোর সকল স্তরে রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্ত করে রাখাইনে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এই প্রতিশ্রুতির প্রতি তাদের অবিচল থাকতে হবে। তা না হলে এটিকে সারাবিশ্বে জাতিগত নিধন হিসেবে দেখা হবে, যা বাংলাদেশ মেনে নেবে না। আমরা এ বিষয়ে আরাকান বাহিনীর প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছি।
প্রশ্ন : মানবিক সহায়তা প্রদানে নিরাপত্তা ঝুঁকি কী কী?
উত্তর : সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা যিনি প্রদান করেন এবং যিনি গ্রহণ করেন উভয়ের জন্যই নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে। ল্যান্ডমাইন ও আইইডির মতো বিস্ফোরক নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য হুমকি। সহায়তা প্রদানের আগে এই বিষয়গুলো সমাধান করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : রাখাইনে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সম্পর্কে আঞ্চলিক দেশগুলোর অবস্থান কী?
উত্তর : আসন্ন মানবিক বিপর্যয় থেকে মানুষের জীবন বাঁচানো বিশ্ব সম্প্রদায়ের একটি সম্মিলিত দায়িত্ব। এই সংকট মোকাবিলায় সবাইকে একযোগে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রাখাইনে স্থিতিশীলতা বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার। স্থিতিশীল না হলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা একেবারেই কম।
প্রশ্ন : আমরা সাম্প্রতিককালে আরও রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসতে দেখছি। যদি এটি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশ কীভাবে এটি মোকাবিলা করার পরিকল্পনা করছে?
উত্তর : বাংলাদেশের পক্ষে আরও বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব না। ২০২৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরাকান বাহিনী এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘাতের সময় রাখাইন থেকে বিপুল পরিমাণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপরেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যদিও সেটি সংখ্যায় কম। আরও মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ না করে সেটি ঠেকাতে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সমন্বয় করছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সরকার আরাকান বাহিনীকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর আর কোনো সহিংসতা, বৈষম্য এবং বাস্তুচ্যুতি যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আরাকান বাহিনীকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনসহ সকল আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে। গোটা বিশ্ব তাদের কার্যক্রম দেখছে। বাংলাদেশ আরাকান বাহিনীর সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে কি না তা এই অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বের ওপর নির্ভর করবে।