চট্টগ্রাম বন্দর কোনোভাবেই বিদেশিদের হাতে দেওয়া যাবে না : গয়েশ্বর

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে দেওয়া হলে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।
আজ রোববার (১৫ মে) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর একটি লাভজনক এবং প্রাকৃতিক বন্দর। সেটি কোনোভাবেই বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে এই প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে ‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও আন্দোলন’।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দেশে তো দুর্নীতি কমেনি বরং বেড়েছে। কারণ হাসিনার আমলের ওই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনও রয়ে গেছে। এই সরকার তো দুর্নীতি রোধে হাত দেয়নি, কয়জনকে ধরা হয়েছে? ধরার উদ্যোগও নেয়নি। এমনকি বিচারও করেনি। এই মুহূর্তে দেশ ও বন্দর বাঁচানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বন্দর চালানোর জন্য যদি দেশে লোক না থাকে তাহলে বিদেশ থেকে আমরা এক্সপার্ট আনতে পারি। যেমনটি গার্মেন্টস শিল্প উন্নয়নে বিদেশের সহযোগিতা নেওয়া হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কোনোভাবেই বিদেশিদের দেওয়া যাবে না।
শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলন প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, আমরা ৩১ দফা নিয়ে আন্দোলনে আছি। মাঝখানে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। এরপর ছাত্ররাও আসে। অর্থাৎ সংস্কার নিয়ে আমরা তো একমত আছি। বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলো তো একমত। তাদের ডেকে পরামর্শ নিয়ে সংস্কারের পথ ত্বরান্বিত করেন।
বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, আজকে দেশ বাঁচাতে গিয়ে সবাই গণতন্ত্রের প্রশ্নে একমত। আমরা চাই ড. ইউনূস সফল হোন। তিনি সফল মানে তো জুলাই অভ্যুত্থানের সফলতা। আজকে ছাত্ররা ডেইলি সচিবালয়ে যায় কেন? ওসির টেবিলের সামনে বসে থাকে কেন? আমাদের অন্য কিছু মনে করবেন না। তবে আমরা লড়াই করা জাতি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদার সভাপতিত্বে সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান চেয়ারম্যান ও দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও আন্দোলনের মূল সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম।
এলিডিপির মহাসচিব তমিজ উদ্দিন টিটুর সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির (একাংশ) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর, আমজনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান প্রমুখ।
মোস্তফা জামাল হায়দার সরকারের সমালোচনা করে বলেন, নয় মাসে একজনেরও বিচার হয়নি। তারা চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলছি—সেটি বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দরকার হলে দেশের মেধাবী কর্মকর্তা দিয়ে বন্দর পরিচালনা করুন। আমরা আমাদের অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রকে কারও কাছে লিজ দিব না।
সরকারের উদ্দেশে মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, আপনাদের ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। আপনারা দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। উপদেষ্টারা একের পর এক বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন।
স্বাগত বক্তব্যে এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, ১৩৮ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর চালু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর একটি প্রাকৃতিক বন্দর। সেটি জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ জাহাজ ভেড়াতে জোয়ার-ভাটার দরকার হয়। সেখানে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও কলম্বো থেকে ফিডার জাহাজে এক হাজার থেকে আড়াইহাজার কন্টেইনার সংবলিত জাহাজ ভেড়ে। সেখানে একটি বাঁক থাকায় ১৯০ মিটারের বেশি বড় জাহাজ ভেড়ানো যায় না। বিশ্বের কোনো শক্তি এসে সেখানে এর চেয়ে বড় জাহাজ ভেড়াতে পারবে না। বরং আমরা নতুনভাবে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কথা বলছি। যাতে বন্দর সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে না যায়। বিদেশি কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে তারা নিজের মতো করে ট্যারিফ নির্ধারণ করবে।
শাহাদাৎ হোসেন সেলিম আরও বলেন, বন্দর নিয়ে আমাদের নিরাপত্তা ও জাতির স্বার্থ দেখতে হবে। আজকে জিটুজি পদ্ধতিতে বন্দর দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। আবার পিপিপি পদ্ধতিতে দেওয়ার কথা বলছে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, ২০২১ বা ২০২২ সালের দিকে শেখ হাসিনার মেয়ে পুতুলের জামাই যখন দুবাই কারাগারে আটক তখন সালমান এফ রহমান একটা টার্মিনাল বের করে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার জন্য। তখনও আমরা বিরোধিতা করেছি। আবারও সেই একটি কোম্পানিকে সাবের হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে দেওয়ার কথা শুনছি। আমরা বলছি নতুনভাবে একটা টাকা বিনিয়োগের সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই আয়বর্ধক প্রতিষ্ঠান। সেখানে দুই হাজারের মতো শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত। মাত্র দুই ঈদে আট ঘণ্টা করে ১৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। বন্দরের ট্যারিফের বিভিন্ন ভাগ আছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে তারা নিজের মতো ট্যারিফ নির্ধারণ করবে। বর্তমানে বন্দর ১০০ ডলার আয় করলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে আট থেকে নয় ডলার এবং সেটি বাংলাদেশি টাকা। আর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় এর চেয়ে দ্বিগুণ/তিন গুণ দিতে হবে। ডিপি ওয়ার্ল্ড তো কোনো গভর্নমেন্ট না। চট্টগ্রাম বন্দরও কোনো গভর্নমেন্ট না। তাহলে জিটুজি কীভাবে হবে?
সেলিম বলেন, বন্দরের ব্যবস্থাপনা নিয়ে তো ব্যবসায়ীরা কোনো কথা বলেনি। তাহলে সেটি কেন বিদেশি কোম্পানিকে দিতে হবে? আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে যাতে চট্টগ্রাম বন্দর কাউকে দেওয়া না হয়।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উত্তম। বাংলাদেশের যে সম্পদ তা খুব সীমিত। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম বন্দর অন্যতম। ফলে দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্দর দেওয়ার বিষয়ে গণশুনানি করুন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করুন। কারণ আপনারা তো অন্তর্বর্তী সরকার। সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সরকারের উচিত অতিদ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেছি। আজকে এ বিষয়ে সবাই সোচ্চার হয়েছে। বর্তমান সরকারের চিন্তা ভাবনা করা দরকার ছিল। সবকিছু করার ম্যান্ডেট তো অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তাদের কাজ হলো গণহত্যার বিচার করা, আহতদের সুচিকিৎসা করা, নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচন দিন। বন্দর লিজ দেওয়া, এনবিআর ভাঙা আপনাদের কাজ না। সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করবেন না। দ্রুত নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা দিয়ে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন। করিডর, বন্দর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। নির্বাচিত সরকার সেটি দেখবে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, সেলিম যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে একমত। দেশ ও জাতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। নয় মাস আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবুও সরকার দেশের যেসব বিষয়ে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িত সে বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা এ সরকার করতে পারে না।
সাইফুল হক বলেন, অনুগ্রহ করে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে থাকেন। রোডম্যাপ ঘোষণা করে জনগণকে আশ্বস্ত করেন। উপদেষ্টারা একের পর এক বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ ভাবছেন। যাদের কারণে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তাদের অব্যাহতি দেন, না হলে অপসারণ করেন। সরকার সঠিকভাবে মনযোগ সহকারে কাজ করলে ডিসেম্বর তো বটেই তার আগেও নির্বাচন করা সম্ভব।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, আগামীতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সরকার চট্টগ্রাম বন্দর লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে না এলে আমরা বৃহত্তর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।