ক্ষমতা ছাড়তে শেখ হাসিনার পা ধরে কান্নাকাটি করেন শেখ রেহানা
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে স্কুলছাত্র আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ আমলে নিয়ে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে নির্দেশ দেওয়া, হত্যা, ষড়যন্ত্র, সহযোগিতাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগে ৫ আগস্ট দুপুরে গণভবনে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে রাজি করাতে শেখ রেহানা তার পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মো. গোলাম মুর্তজার নেতৃত্বে তিন সদস্যর ট্রাইব্যুনাল আজ রোববার (২৫ মে) অভিযোগটি আমলে নিয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য ৩ জুন দিন ধার্য করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম অভিযোগটি আদালতে পড়ে শোনান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, ফারুক আহম্মেদ, গাজী এম এইচ তামিম, এ এম সুলতান মাহমুদ, তারিকুল ইসলাম ও ব্যারস্টিার শাইখ মাহাদী।
এ মামলায় আট আসামির বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগ আনা হয়। সরাসরি হত্যা, সুপরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশনার জন্য ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুলের নির্দেশনায় হুকুম দাতার অভিযোগ আনা হয়।
এ ছাড়া শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে রাইফেল দিয়ে সরাসরি হত্যার অভিযোগ আনা হয়। আট আসামির মধ্যে শেষের চারজন কারাগারে, বাকিরা পলাতক রয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনটি কয়েকটি ভাগে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। প্রথমভাগে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের রক্ষী বাহিনী দিয়ে নির্যাতন চালিয়ে বাকশাল কায়েমের ইতিহাস ও ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত ক্ষমতায় এসে বিরোধী মতকে নির্যাতন করে ক্রমান্বয়ে স্বৈরাচার হয়ে উঠার ইতিহাস পড়ে শোনান। এছাড়া রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সকল অবকাঠোমোকে ধ্বংস করে দুর্নীতিকে নিয়মে রূপ দেওয়া হয়। গত পনের বছরে গুম, মামলা, হামলা দিয়ে নির্যাতন করে বিরোধীমতকে দমন ও নিপীড়নের ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জুলাইয়ের শুরু থেকে বৈষম্যরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, চীন থেকে এসে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দেওয়া ও এর পটভূমি পড়ে শোনান। পরে শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে হত্যা, নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়।
এ ছাড়া শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকীর নির্দেশনায় গুম- হত্যার নির্দেশনা, ফোর গ্যাং অর্থাৎ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে ছাত্র জনতাকে হত্যার জন্য শেখ হাসিনাকে অনড় রাখার চিত্র তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বিজিবি, র্যাব, পুলিশকে ব্যবহারের বিষয়টি অভিযোগে আনা হয়।
৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সর্বশক্তি ব্যবহার করা হয়। সেনাবাহিনী ছাত্রদের ওপর গুলি চালাবে না বললে শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। পরে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে শেখ রেহানা পায়ে ধরে কান্নাকাটি করেন বলে অভিযোগে বলা হয়।
সর্বশেষ, গণঅভ্যুত্থানে যাওয়ার আগে বাবা-মাকে লিখে যাওয়া শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের চিঠি আদালতে পড়ে শোনানো হয়। এ সময় শহীদ আনাসের চিঠি পড়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন চিফ প্রসিকিউটর।
৫ আগস্ট ২০২৪ সালে রাজধানীর চানখারপুল এলাকায় আসামিগণ কর্তৃক নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো ইমামুল হক এবং মানিক মিয়াকে গুলি করে হত্যা করে।
গত ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগরীর চানখাঁরপুল এলাকায় শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালানো হয়। এতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। আগ্নেয়াস্ত্র, এপিসি কার, লাখ লাখ বুলেট, হেলিকপ্টার, ড্রোন ব্যবহার করে এই আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে পুলিশ। তদন্তে উঠে এসেছে, চানখাঁরপুলের হত্যাকাণ্ডে পলাতক আসামি হাবিবুর রহমানসহ অন্যান্য আসামিরা ঘটনাস্থলে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন।
তারা অধীনস্থদের নির্দেশ প্রদান, সহযোগিতা ও সহায়তার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনে ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া তারা এসব অপরাধ সংঘটন থেকে অধীনস্থদের বিরত রাখেননি বা পরবর্তী সময়ে কোনো ব্যবস্থাও নেননি। এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ট্রাইব্যুনালে করা মামলাটির কম্প্লেইন রেজিস্ট্রার নম্বর-১৪৯। ৭ই অক্টোবর থেকে এ মামলাটির তদন্ত শুরু করে ১৯৫ দিনের তদন্ত শেষে ২০ এপ্রিল চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত শেষে ৯০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে মোট ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সংযুক্ত আছে ১৯টি ভিডিও, ১১টি পত্রিকার প্রতিবেদন, ২টি অডিও, ১১টি বই ও রিপোর্ট এবং ৬টি মৃত্যু সনদ। প্রতিবেদনে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে ৬ জনকে হত্যার ঘটনা উঠে আসে।
এতে দুটি অডিও কল রয়েছে। এর মধ্যে একটি অডিও কলে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশ দেয়ার রেকর্ড রয়েছে। এতে শেখ হাসিনার পুলিশকে গুলি করে মানুষ হত্যার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশনাও রয়েছে। হাসিনা যে মানুষ হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেটি হাবিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অন্য কর্মকর্তাদের জানাচ্ছিলেন। অর্থাৎ পুলিশ কমান্ড সেন্টার থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন হাবিবুর রহমান। এ ছাড়াও তদন্ত সংস্থা ১১টি বই দাখিল করেছে। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনও রয়েছে। এতে ছয়জন শহীদের ছয়টি ডেথ সার্টিফিকেট সংযুক্ত করা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হলে এখানে এখন পর্যন্ত অভিযোগ এসেছে ৩৩৯টির মতো। তদন্ত চলছে ৩৯টির। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে বলা হয়েছে, তদন্তের প্রাথমিক সত্যতার আলোকে হত্যা ও গুমসহ ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে ২২টি (বিবিধ) মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত মোট অভিযুক্ত ব্যক্তি শেখ হাসিনাসহ ১৪১ জন। তাদের মধ্যে ৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক ৮৭ জন। ১৪১ আসামির মধ্যে ৭০ জন বেসামরিক লোক, ৬২ জন পুলিশ র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং অবসরপ্রাপ্ত বা বরখাস্ত করা সামরিক কর্মকর্তা নয়জন।
এই ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। এই মামলার অন্য আসামিরা হলেন, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ আলম, মো. আখতারুল ইসলাম, রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও মো. নাসিরুল ইসলাম। তবে আট আসামির মধ্যে শেষের চারজন কারাগারে, বাকিরা পলাতক।