এশিয়ার পারস্পরিক নির্ভরতাকে সহযোগিতায় রূপান্তরের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধিষ্ণু অস্থিরতার আবহে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতাকে সংঘাতের বদলে সহযোগিতার এক নতুন দিগন্তে রূপান্তরের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
আজ বৃহস্পতিবার (২৯ মে) টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলের ফুজি রুমে অনুষ্ঠিত নিক্কেই ফোরামের ৩০তম ‘ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে তিনি ‘একটি অশান্ত বিশ্বে এশিয়ার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার এই বক্তব্যে তিনি ‘তিনটি শূন্য’– দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও নেট কার্বন নির্গমন– এর এক সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে এশিয়ার জন্য নতুন এক ভবিষ্যৎ নির্মাণের আহ্বান জানান।
ভাষণের শুরুতেই অধ্যাপক ইউনূস নিক্কেই ইনকর্পোরেটেডের প্রেসিডেন্ট ও সিইও সুয়োশি হাসিবে-কে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি ২০০৪ সালে নিক্কেই এশিয়া পুরস্কার পাওয়ার স্মৃতির কথা উল্লেখ করে বলেন, এরপর থেকে জাপানের সঙ্গে তার একটি বিশেষ ব্যক্তিগত সংযোগ রয়েছে। জাপানি জনগণের সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণের প্রতি উষ্ণ সমর্থন তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা ও এশিয়ার ভূমিকা
অধ্যাপক ইউনূস বর্তমান বিশ্বকে ‘অশান্ত’ ও ‘অনিশ্চয়তার’ সময় হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এশিয়াতে শান্তি ভঙ্গুর হয়ে ক্রমশ উত্তেজনা বাড়ছে। ইউক্রেন, গাজা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যুদ্ধ এবং মানবসৃষ্ট সংঘাত হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। তিনি মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকটের কথাও উল্লেখ করেন।
সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘটিত সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, আমরা যুদ্ধে বিলিয়ন বিলিয়ন ব্যয় করছি, যার ফলে আমাদের লাখ লাখ মানুষ অনাহারে বা মৌলিক চাহিদার জন্য লড়াই করছে।’ তিনি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার জন্য দুই দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানান। দক্ষিণ এশিয়ায় অব্যাহত শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আশা ব্যক্ত করেন।
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতির নৈতিক দ্বিধা, বাণিজ্য বিধিনিষেধের উত্থান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে বর্তমান বিশ্বের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন। পাশাপাশি, জাতি, সমাজ, নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আস্থার হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ-কোরিয়া প্রজাতন্ত্রেও বিভাজন, অসন্তোষ এবং অস্থিতিশীলতা দেখা গেছে, যার ফলে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।
বাংলাদেশের রূপান্তরমূলক যাত্রা ও বৈশ্বিক অবদান
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘গত বছর ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা এক রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম। ফলস্বরূপ আমার সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে।’ তিনি জানান, তার সরকার জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য, ন্যায়বিচার, সাম্য, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে কঠোর পরিশ্রম করছে। একই সঙ্গে, গণতন্ত্রে মসৃণ রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি এটিকে ভুল সংশোধন, নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং একটি ন্যায্য সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ হিসেবে দেখেন।
অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তায় অবদান রাখছে। এছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
‘তিনটি শূন্য’ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিশা
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের বাসস্থান এশিয়ায়। এটি অনিশ্চয়তার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হলেও একই সঙ্গে সম্ভাবনারও কেন্দ্রবিন্দু। তিনি বিশ্বাস করেন, এশিয়ার কাছে একটি ভিন্ন পথ দেখানোর সুযোগ ও দায়িত্ব রয়েছে। যেটি হবে—শান্তি, সংলাপ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির পথ।
প্রধান উপদেষ্টা তার ‘তিনটি শূন্য’ এর সাহসী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন : শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নেট কার্বন নির্গমন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং একটি দিকনির্দেশনা। এটি একটি লক্ষ্য, যার দিকে সরকার, ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তিসহ সবাই কাজ করতে পারে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি একটি নতুন ধরনের অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন, যা কেবল প্রতিযোগিতার ওপর নয়, বরং সহানুভূতির ওপর নির্মিত। এখানেই সামাজিক ব্যবসার ধারণা আসে—একটি ব্যবসা যা শুধু লাভই করে না, বরং সমস্যার সমাধানও করে।
এশিয়ার জন্য ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা
অধ্যাপক ইউনূস ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এশিয়ার দেশগুলোর জন্য ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন :
১. আন্তঃনির্ভরতাকে সহযোগিতায় রূপান্তর : এশিয়ার বৈচিত্র্যকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে হবে, সংঘাত নয়।
২. শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা : আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়নে নেতৃত্ব দিতে হবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য ও টেকসই প্রযুক্তিগত বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে।
৩. অন্তর্ভুক্তি, ক্ষমতায়ন ও স্থায়িত্ব : প্রান্তিক মানুষদের সুযোগ দিতে হবে এবং এমন একটি নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে যা প্রতিটি স্তরে অন্তর্ভুক্তি, ক্ষমতায়ন ও স্থায়িত্বকে উৎসাহিত করে।
৪. মানুষের মধ্যে বিনিয়োগ : কেবল অবকাঠামো ও শিল্পায়নে নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ব্যবসা ও ডিজিটাল অ্যাক্সেসের মাধ্যমে মানুষের মধ্যেও বিনিয়োগ করতে হবে।
৫. সবুজ পরিবর্তন : এশিয়ার উচিত একটি প্যান-এশিয়ান সবুজ রূপান্তর, যা যুব, উদ্যোক্তা ও সম্প্রদায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি ও বৃত্তাকার অর্থনীতিকে সমর্থন করতে হবে।
৬. যুবসমাজের সম্ভাবনা কাজে লাগানো : এশিয়ার যুবসমাজকে তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য সরঞ্জাম, বিশ্বাস ও স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের চাকরি তৈরির জন্য উৎসাহিত করতে হবে, কেবল চাকরি খোঁজার জন্য নয়।
সবশেষে, তিনি বলেন, এশিয়াকে কেবল অর্থনৈতিক শক্তিই নয়, বরং একটি নতুন নৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান করতে হবে—যা ক্ষমতার চেয়ে শান্তি, প্রতিযোগিতার চেয়ে সহযোগিতা, স্বল্পমেয়াদি লাভের চেয়ে স্থায়িত্বকে সমর্থন করে। তিনি সবাইকে এক সঙ্গে একটি উন্নত বিশ্ব কল্পনা করার সাহস করতে এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে আহ্বান জানান।
‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনও লেখা হয়নি। আমরা এটি এক সঙ্গে লিখব’, বলে অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণ শেষ করেন এবং বাংলাদেশ-জাপান মৈত্রী দীর্ঘজীবী হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন।