‘পেঁপে পাতার রস প্লাটিলেট বাড়ায়– বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়’

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, পেঁপে পাতার রসে প্লাটিলেট বাড়ানোর বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয় বলে জানিয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল হাসান।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির (বিএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল মিলনায়তনে আজ মঙ্গলবার (২৪ জুন) এক সেমিনারে ‘ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫ : হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড’ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ডা. নাজমুল হাসান এ কথা বলেন।
ডা. নাজমুল হাসান বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের হালকা উপসর্গে যেমন (৩-৫ দিন জ্বর, মাথাব্যথা, হালকা গা ব্যথা) রোগীকে বাড়িতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও তরল পানীয় (স্যালাইন, ফলের রস, স্যুপ) গ্রহণ করতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য কেবল প্যারাসিটামল ব্যবহার করা যাবে (২৪ ঘণ্টায় ৩ গ্রামের বেশি না)। অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা ব্যথানাশক জাতীয় ওষুধ নিষিদ্ধ, কারণ এগুলো রক্তপাতের ঝুঁকি বাড়ায়। জ্বর কমে যাওয়ার পর হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়া, বারবার বমি, পেটব্যথা, রক্তপাত, ঘনঘন দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট বা মলিন চামড়া, অস্থিরতা, অজ্ঞানভাব, মাথাঘুরানো—এই উপসর্গগুলো দেখা গেলে এবং গর্ভবতী নারীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
নাজমুল হাসান তার প্রবন্ধে বলেন, এ সময় স্টেরয়েড (যেমন ডেক্সামেথাসন, হাইড্রোকরটিসন) ব্যবহার রোগীর ক্ষতিকারক হতে পারে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, ফুসফুসে পানি জমার ঝুঁকি বাড়ায়। গবেষণায় প্রমাণিত, এতে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় কোনো উপকার হয় না। অল্প কিছু ক্ষেত্রে স্টেরেয়ড ব্যবহার করলে তা বিশেষজ্ঞের পরামর্শে নিতে হবে।
ডেঙ্গু গাইডলাইনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই জানিয়ে ডা. নাজমুল হাসান তার প্রবন্ধে বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। শুধু যদি নিশ্চিত ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ থাকে (যেমন নিউমোনিয়া), তখন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবহার করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বিপজ্জনক।
ডা. নাজমুল হাসান আরও বলেন, সম্প্রতি অনেকেই ডেঙ্গু রোগে প্লাটিলেট বাড়ানোর ঘরোয়া উপায় হিসেবে পেঁপে পাতার রস ও অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করছেন। তবে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর মতে, পেঁপে পাতার রসে প্লাটিলেট বাড়ানোর বিষয়টি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এ ছাড়া ভুল মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, পেটব্যথা ও লিভারের সমস্যাও হতে পারে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় এটি কোনো বিকল্প নয়। বিশ্রাম, পর্যাপ্ত তরল খাবার গ্রহণ এবং সময়মতো হাসপাতালে যাওয়া-ই এখন সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
তিনি জানান, প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন প্রয়োজন হয় তখনই যদি রোগীর প্লাটিলেট সংখ্যা খুব কম (১০,০০০-এর নিচে), রক্তপাত হচ্ছে অথবা অপারেশন বা ইনভেসিভ প্রসিডিউরের প্রয়োজন পড়ে। শুধু প্লাটিলেট কম থাকলেই রক্ত দেওয়া উচিত নয়। এতে অতিরিক্ত চাপ বা জটিলতা দেখা দিতে পারে। সম্পূর্ণ রক্ত বা রেড ব্লাড সেল ট্রান্সফিউশন, শুধু তখনই বিবেচ্য, যখন রোগীর হিমোগ্লোবিন খুব কম বা রক্তপাতজনিত শক দেখা দেয়।
সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার ও ফিভার ক্লিনিক চালু করা প্রয়োজন উল্লেখ করে ডা. মো. নাজমুল হাসান বলেন আইভি ফ্লুইড, রক্ত, রক্তের উপাদান ও জরুরি চিকিৎসার সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনায়।
নাজমুল হাসান বলেন, ডেংগু প্রতিরোধে জমে থাকা পানির পাত্র পরিষ্কার করা, ঘরের ভিতর ও বাইরের জলাধান ঢেকে রাখা, সপ্তাহে অন্তত একবার পানি ফেলে দেওয়া ও ব্লিচিং করা প্রয়োজন। কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা ও স্প্রে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে ভুল চিকিৎসা ও গুজব ডেঙ্গুকে মারাত্মক করে তোলে। সরকারি নির্দেশনা মেনে চললে এবং নিজের আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। ভুল তথ্য ও গুজব থেকে দূরে থাকুন, স্বীকৃত চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এই সিএমইতে রিসেন্ট ট্রেন্ড ইন ফেব্রাইল ইলনেসেস ইন বাংলাদেশ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খান, কোভিড-১৯ ট্রেন্ড ২০২৫ ইন বাংলাদেশ : এভিডেন্স বেইসড ইনফরমেশন বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী ও ডেঙ্গু গাইডলাইন ২০২৫ : হোয়াট হ্যাজ চেঞ্জড বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. নাজমুল হাসান।
প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) ও ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহিনুল আলম।
প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেসিক সায়েন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী, ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ আরাফাত, অধ্যাপক ডা. আব্দুল কাদের, অধ্যাপক ডা. কাজী মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. তানভীর ইসলাম, অধ্যাপক ডা. ফেরদৌস উর রহমান প্রমুখ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. খালেদ মাহবুব মোর্শেদ মামুন।