ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কম, তবু মৃত্যুর ঝুঁকিতে নারীরাই এগিয়ে

বাংলাদেশে ডেঙ্গু আর মৌসুমি রোগ নয়, এটি সারা বছরব্যাপী জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে। চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫,২০৬ জনে। এর মধ্যে পুরুষের হার ৬০.৪ শতাংশ হলেও নারীর হার মাত্র ৩৯.৬ শতাংশ। কিন্তু মৃত্যুর পরিসংখ্যান একেবারে ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে—মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক (৪৮.৯%) নারী। গত বছরও একই ধারা দেখা গিয়েছিল; ২০২৪ সালে আক্রান্ত নারীর হার ছিল মাত্র ৩৬.৯ শতাংশ, অথচ মৃত্যুর হার ছিল ৫১.১ শতাংশ। অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও নারীরা মৃত্যুর ঝুঁকিতে অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে নারীর মৃত্যুহার বেশি হওয়ার পেছনে শুধুমাত্র রোগের জৈবিক কারণ নয়, সামাজিক কাঠামো, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, স্বাস্থ্যসেবায় সীমিত প্রবেশাধিকার, দারিদ্র্য ও পারিবারিক সিদ্ধান্তে নারীর সীমিত ভূমিকা বড় ভূমিকা রাখে।
বিএমসি পাবলিক হেলথ, ২০২৩ এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে বাধার সম্মুখীন হন। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, পরিবারের অনুমতি না পাওয়া, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব বা একা হাসপাতালে যেতে না পারা। বিশেষত গ্রামীণ নারীরা এ সমস্যায় বেশি ভোগেন। চিকিৎসা নিতে দেরি হওয়ায় রোগ জটিল অবস্থায় পৌঁছে যায়, যা মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মাত্র ১২ শতাংশ নারী নিজস্ব স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীলতা এবং সামাজিক কাঠামো নারীদের চিকিৎসা গ্রহণে দেরি ঘটায়, যা ডেঙ্গুর মতো সংক্রমণ রোগে প্রাণহানির ঝুঁকি বাড়ায়।
আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত কিছু তথ্যানুযায়ী, নারী ও পুরুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্যও মৃত্যুহারের একটি বড় কারণ। নারীরা গর্ভাবস্থা, অ্যানিমিয়া, হরমোনগত পরিবর্তন এবং অপুষ্টির কারণে অনেক সময় ইমিউন প্রতিক্রিয়ায় দুর্বল থাকে। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণ সহজেই জটিল আকার ধারণ করে।
অনেক নারী ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণকে গুরুত্ব না দিয়ে অবহেলা করেন এবং ‘সাধারণ জ্বর’ ভেবে চিকিৎসা নেন না। পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক সচেতনতার অভাবও চিকিৎসা বিলম্বিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, পুরুষ ও নারীর চিকিৎসা গ্রহণে সময় এবং প্রতিক্রিয়ায় পার্থক্য মৃত্যুহারে প্রভাব ফেলে।
অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনবসতি এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে শহরাঞ্চলে এডিস মশার প্রজনন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঢাকায় ব্রেটো সূচক (বিআই) আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। নারীরা যেহেতু বাড়ির আশপাশে বেশি সময় কাটান, তাই এ পরিবেশে তাদের ঝুঁকিও বেশি।
গবেষকরা বলছেন, এখনই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে লিঙ্গভিত্তিক ঝুঁকি বিবেচনায় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কেবল আক্রান্ত সংখ্যা কমানো নয়, মৃত্যুহার কমাতে নারীদের জন্য আলাদা নজরদারি, দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা বাড়ানো এবং সচেতনতা কর্মসূচি হাতে নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি, ড্রেন, সেপটিক ট্যাংক ও পানি জমে থাকা স্থানে নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রম এবং সমন্বিত ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ চালু রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আক্রান্ত সংখ্যা দিয়ে নয়, মৃত্যুহার দিয়েই এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করতে হবে। কারণ সংখ্যায় কম হলেও মৃত্যুর সারিতে নারীরাই সবচেয়ে বেশি। এখনই নারীদের বিশেষ ঝুঁকি বিবেচনায় নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে, ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নারীরাই থেকে যাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অসহায় জনগোষ্ঠী।
লেখক: কীটতত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ,রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।