ফেনীতে বন্যায় ঘরহারা ৪৯ পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত ৯১৫ বসতবাড়ি

ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনীর তিন উপজেলা- ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার ১৩২টি গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি। এখনও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রয়েছেন বন্যাদুর্গতরা। ফুলগাজীতে বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৪৯টি পরিবার এখন অন্যের ঘরে (আত্মীয় বা পাশের প্রতিবেশীর বাড়িতে) আশ্রয় নিয়েছে। কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে বাঁশের খুঁটির ওপর পলিথিন বা প্লাস্টিকের ত্রিপল দিয়ে মাথার ওপরে ছাউনি করে অবস্থান করছেন। গত শনিবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বন্যার আবাসন খাতের ক্ষয়ক্ষতির এ চিত্র তুলে ধরা হয়।
সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ফুলগাজীতে ২০টি এবং পরশুরামে ২৮টি কাঁচা ও আধাপাকা ঘর সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতি ঘর দুই লাখ টাকা ধরে প্রায় এক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এ ছাড়া আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- ফুলগাজীতে ৪৯৫টি, ছাগলনাইয়ায় ৩০৪টি এবং পরশুরামে ৬৯টি ঘরবাড়ি। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ কোটি টাকা।
গত রোববার সরেজমিনে ফুলগাজীতে গিয়ে দেখা যায়, বন্যায় বিধ্বস্ত বসতভিটায় বসে আছেন উত্তর দৌলতপুর গ্রামের হোসনে আরা বেগম। পাশের একটি ছোট্ট স্কিম ঘরে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। এক বন্যা আমাকে পুরো নিঃস্ব করে দিয়েছে। কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। ছোট তিন সন্তানকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিলাম। এক সপ্তাহ পর ফিরে এসেছি। কী করে ঘর তুলব- মাথায় আসছে না। এখন পর্যন্ত আমাদের পুনর্বাসনে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।’
মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি এখনও বিপৎসীমার ওপরে বইছে। ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৬৭টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গত সোমবার রাত ১০টার দিকে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর পশ্চিমমাথা এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে মো. রাজুসহ চার বন্ধু বেড়িবাঁধের ভাঙনকবলিত স্থানে জাল দিয়ে মাছ ধরতে যান। একপর্যায়ে রাজু প্রবল স্রোতে ভেসে যান। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ ৪৪টির বেশি গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠাননগর, রাধানগর ও শুভপুর ইউনিয়নেরও ১৫টির বেশি গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে।
ফেনী সদরে ৯টি এবং দাগনভূঞা উপজেলার ২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু জায়গায় মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালে পর্যন্ত উঠেছে বন্যার পানি।
পানি নামার পর এসব এলাকার মানুষ আশ্রয় খুঁজছেন। দুর্গতদের সহায়তায় স্থানীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ত্রাণ সহায়তা নিয়ে মাঠে কাজ করছে। চলতি মাসের শুরুতে মুহুরি, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পরশুরাম অংশে ২২টি ও ফুলগাজী অংশে ১৯টি। মোট ৪১টি স্থানে নদীভাঙন দেখা দেয়।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, ‘বন্যায় আবাসনসহ আরও কয়েকটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন এনজিও ও সংগঠন আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। তবে সরকারিভাবে পুনর্বাসনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনও আসেনি।’
ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এবারের বন্যায় ফেনীতে প্রায় এক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারের নির্দেশনা পেলে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা হবে।’
আবাসন খাত ছাড়াও এবারের ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে কৃষি খাতে ৩৮ কোটি ৭ লাখ, মৎস্য খাতে ৮ কোটি ৭১ লাখ, প্রাণিসম্পদ খাতে ৬৫ লাখ, সড়ক খাতে ৯০ কোটি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতি ৯ কোটি টাকা।
গত বছরের (২০২৪) ভয়াবহ বন্যায় ফেনীতে ৭০ হাজার ৪১৫টি আধাপাকা ও কাঁচা ঘর, আসবাবপত্র এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম পানিতে তলিয়ে যায়। এতে আনুমানিক ৫৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। ওই বন্যায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৭ হাজার ৩৫০টি পরিবার এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫৬ হাজার ৬৫টি ঘর।