এটা কোনো দেশ হলো, আপনারাই বলেন : সায়ানের বাবা

মোহাম্মদ ইউসুফ, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তার স্ত্রীও একই কলেজের রসায়নের প্রভাষক। দুটি ফুটফুটে সন্তানের জনক তিনি। কিন্তু আজ তার সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে তিনি শুধু এক সন্তানহারা পিতা। কান্নায় ভারি হয়ে আসা কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি বললেন, ‘আমি আর এ দেশে থাকবো না। এদেশের পলিটিশিয়ানরা এদেশটাকে পলিউট করে ফেলছে। আমরা থাকবো না এই দেশে।’
এক ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নিজের সন্তানকে হারিয়ে তার জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। যে শিক্ষক প্রতিদিন ক্লাসরুমে বিজ্ঞানের জটিল সূত্র সহজ করে বোঝাতেন, আজ তিনি নিজেই জীবনের এক জটিল সমীকরণে আটকা পড়েছেন। তার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দে মিশে আছে গভীর শোক, তীব্র ক্ষোভ আর এই দেশের প্রতি এক বুক হতাশা। সন্তানের শূন্যতা আর রাজনীতি তাকে এতটাই পীড়িত করেছে যে, জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি দ্বিধা করছেন না। এই আর্তনাদ শুধু এক পিতার নয়, এটি যেন দেশের প্রতি এক বেদনাহত আত্মার প্রতিধ্বনি।
ইউসুফের দুই সন্তান। এক ছেলে এক মেয়ে। এর মধ্যে বড় ছেলে সায়ান। দুইজনই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ত। গতকাল রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান (এফটি-৭ বিজিআই) বিধ্বস্তের ঘটননায় ছেলে সায়ানের শরীরের ৯৫ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৩টা ৫০ মিনিটে মারা যান সায়ান।
ছেলের মৃত্যুর খবরে ডুকরে কেঁদে ওঠে সায়ানের বাবা ইউসুফ। আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বার্ন ইউনিট।
আহাজারি করে ইউসুফ বলেন, ‘আমার ছেলে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, পুরো কলেজে ফার্স্ট হয়। আমার ছেলে সবচেয়ে স্মার্ট’... বলেই জ্ঞান হারান তিনি।
সায়ানের বাবা গতকাল সোমবার বিকেলে খবর পান, ছেলে দগ্ধ হয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যালে ভর্তি, সেখান থেকে আনা হয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিউতে। সায়ানের শরীরের ৯৫ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। রাত ৩টা ৫০ মিনিটে মারা যান সায়ান।
জ্ঞান ফিরেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘এটা কোনো দেশ হলো বলেন। আপনারাই বলেন! লোকালয়ের ওপর দিয়ে কেন একটি ট্রেনিং বিমান চলবে? বলেন। এ দেশে কোনো মানুষের নিরাপত্তা নেই ‘
‘আমি আর এ দেশে থাকব না। আমার পুরো ফ্যামিলি এ দেশ থেকে চলে যাব,’ বলেন ইউসুফ।
ছেলের স্মৃতিচারণ করে ফের কেঁদে ওঠেন এই বাবা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট, পুরো কলেজে ফার্স্ট হয়। আমার ছেলে সবচেয়ে স্মার্ট। এদেশের পলিটিশিয়ানরা এদেশটাকে পলিউট করে ফেলছে। আমরা থাকব না এই দেশে।’
সায়ানের মা সেই মুহূর্তে কোনো কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। চিকিৎসকরা তাকে স্যালাইন দিয়ে কোনোরকমে সামলে রেখেছেন। যখন তারা সন্তানের পুড়ে যাওয়া হাত দেখতে পেলেন, তখন চোখ দিয়ে শুধু পানি গড়িয়ে পড়েনি; গড়িয়েছে এক নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার বেদনা। সেই পুড়ে যাওয়া হাতে যেন নিভে গেছে মায়ের সব স্বপ্ন, সব ভবিষ্যৎ। এই অসীম কষ্ট তাকে এমন এক নির্বাক স্তব্ধতায় ডুবিয়ে দিয়েছে, যা কেবল একজন সন্তানহারা মা-ই অনুভব করতে পারেন। তার এই নীরব আর্তনাদ হয়তো আর কখনোই থামবে না!