তুহিন হত্যা : গ্রেপ্তার ৮, চার্জশিট হতে পারে ১৫ দিনের মধ্যে

গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে প্রধান আসামী ও তার স্ত্রীসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে, এ মামলার অপর আসামি আরমানকে খুঁজছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গতকাল শুক্রবার (৮ আগস্ট) রাতেই সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত তিনটি চাপাতি, একটি রাম দা ও স্টিক উদ্ধার করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়।
আজ শনিবার (৯ আগস্ট) দুপুরে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে, সংবাদ সম্মেলনে হাজির করার সময় পুলিশের সামনেই গ্রেপ্তারকৃত প্রধান আসামি কেটু মিজান জেল থেকে বের হওয়ার পর সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অর্ধশতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মিজান ওরফে কেটু মিজান (৩৪), তার স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপি (২৮), খুলনা সোনাডাঙ্গা থানার ময়লাপোতা এলাকার আল আমিন (২১), পাবনার ফরিদপুর থানার সোনাহারা এলাকার স্বাধীন (২৮), একই জেলার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়ীয়া গ্রামের ফয়সাল হাসান (২৩), কুমিল্লার হোমনা থানার অনন্তপুর গ্রামের শাহ জালাল (৩২) এবং শেরপুর জেলার নকলা থানার চিতলিয়া গ্রামের সুমন ওরফে সাব্বির (২৬)। তারা সবাই গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।
পুলিশ জানায়, ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে শুরুতে যে নারীকে দেখা গেছে এবং যাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, তিনি হলেন প্রধান আসামির কেটু মিজানের স্ত্রী গোলাপি। এ ছাড়া ফুটেজে চাপাতি হাতে (দাড়িওয়ালা ও মাথায় ক্যাপ পরা) কোপানোর জন্য যাকে দৌড়াতে দেখা যায়, তিনি হলেন কেটু মিজান। সাদা শার্ট ও জিনসের প্যান্ট পরা চাপাতি হাতে দাঁড়ানো অপর ব্যক্তি হলেন স্বাধীন। অপর আসামির নাম আল আমিন। এ ছাড়া আসামি সুমনের কাছে হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি ও সুইস গিয়ার পাওয়া গেছে।
জিএমপির কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান জানান, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডের পরপরই স্থানীয় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সেই ফুটেজ পর্যালোচনা করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আটজনকে শনাক্ত করা হয়। পরে তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের একাধিক দল ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শুক্রবার রাত ১০টার দিকে জিএমপির গোয়েন্দা (দক্ষিণ) গাজীপুর সদর উপজেলার ভবানীপুর এলাকা থেকে প্রধান আসামি মিজান ওরফে কেটু মিজান ও তার স্ত্রী গোলাপিকে গ্রেপ্তার করে। হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া আলামিনকে মহানগরীর বাসন থানা পুলিশ শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
নাজমুল করিম খান আরও জানান, স্বাধীনকে গাজীপুর মহানগরীর শিববাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১। তার ঘাড়ে ডেঞ্জার লেখা ট্যাট্টু রয়েছে। র্যাব গাজীপুর পোড়াবাড়ী ক্যাম্পের কমান্ডার পুলিশ সুপার কে এম এ মামুন খান চিশতী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

জিএমপি কমিশনার জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মিজান ওরফে কেটু মিজানের বিরুদ্ধে পূর্বের ১৫টি মামলা, শাহজালালের বিরুদ্ধে আটটি মামলা, আল আমীন ও স্বাধীন এবং সুমনের বিরুদ্ধে দুটি করে মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জিএমপির বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন খান জানান, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার ঘটনায় বাসন থানায় একটি মামলা হয়েছে। নিহতের বড় ভাই সেলিম এ মামলাটি করেছেন। ঘটনার পর শুক্রবার রাতে রাজধানীর তুরাগ থানা, ময়মনসিংহের গফরগাঁও এবং গাজীপুর মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ওসি শাহীন খান আরও জানান গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে শনিবার বিকেলে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাদের প্রত্যেকের দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করার সময় পুলিশের সামনেই গ্রেপ্তারকৃত প্রধান আসামি কেটু মিজান জেল থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এতে স্থানীয় সাংবাদিকদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
অপরদিকে জিএমপির উপকমিশনার (অপরাধ-উত্তর) রবিউল হাসান জানান, গাজীপুরের সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত অপর একজনকে শনিবার কিশোরগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতের নাম শহিদুল ইসলাম। তার বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। গ্রেপ্তারকৃত শহিদুলকে আনার জন্য বিকেলে পুলিশের একটি টিম কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। এ নিয়ে সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় জড়িত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র্যাবের একটি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত স্বাধীনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শহিদুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার ঘটনায় ময়না তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া গেলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়া সম্ভব হবে। এ ঘটনায় আমাদের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীসহ উপযুক্ত সব তথ্য প্রমাণ রয়েছে। আদালতে আসামিরা যদি নিজেদের অপরাধ স্বীকার না-ও করে, তাহলেও এভিডেন্সই তাদের অপরাধ প্রমাণ করবে।
জিএমপি কমিশনার আরও বলেন, সাংবাদিক হত্যার দায় আমরা এড়াতে পারি না। আমাদের জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। এই স্বল্প জনবল নিয়ে পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ৫ আগস্টের পর পুলিশ এখনও তাদের মনোবল ফিরে পায়নি। তাই এখানে জনগণের সম্পৃক্ততা প্রয়োজন হয়। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এ সময় তিনি যথার্থ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করতে পারার কারণে তুহিন হত্যায় ব্যর্থতা নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং নিহত আসাদুজ্জামান তুহিনের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ের ঈদগাহ মার্কেটের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে। নিহত তুহিন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের হাসান জামালের ছেলে। তিনি দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তুহিন গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি একটি ইউনানী ওষুধ কোম্পানির গাজীপুরের ডিলার ছিলেন। সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার ঘটনায় নিহতের বড় ভাই সেলিম মিয়া বাদী হয়ে গতকাল শুক্রবার অজ্ঞাতদের আসামি করে বাসন থানায় মামলা করেন।