ঠাকুরগাঁওয়ের কোনো হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম নেই, মরছে মানুষ

প্রতি বছর বর্ষার সময় সাপের উপদ্রব বাড়ে। বৃষ্টির পানিতে সাপের বাসস্থান প্লাবিত হলে আশ্রয়ের খোঁজে লোকালয়ের দিকে ছোটে বিষধর এই প্রাণীটি। অনেক সময় মানুষের ঘরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয় তারা। আর মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর সঙ্গে অতর্কিত সাক্ষাৎ হলে সাপগুলো ভয়ে দংশন করে বসে।
প্রতি বছরের মতো এবারের বর্ষায়ও ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়েছে সাপের উপদ্রব। তবে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, জেলার কোনো হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর জন্য অ্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশন নেই। গত দুই সপ্তাহে সাপে কাটা অন্তত ৫ জন রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়পলাশবাড়ী ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের বাসিন্দা ইসরাইল উদ্দিন। তার ছোট ছেলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাকিবুল ইসলামকে গত শুক্রবার (৮ আগস্ট) বিকেলে দংশন করে বিষধর সাপ। ছেলের চিকিৎসার জন্য দুই জেলার চারটি হাসপাতাল ঘুরেও সাপের বিষ নিষ্ক্রিয় করার অ্যান্টিভেনম পাননি ইসরাইল। অসহায় বাবার চোখের সামনে মারা যায় তার আদরের সন্তান সাকিবুল।
হাসপাতালগুলোতে সাপের বিষ নিষ্ক্রিয় করার ইঞ্জেকশন (অ্যান্টিভেনম) মজুদ না থাকায় আদরের সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যর্থ বাবার দুঃখের শেষ নেই। এ ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো গ্রামে। ছেলের মৃত্যুশোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তার মা। গত তিনদিন ধরে চিকিৎসা চলছে তার।
স্থানীয় ও পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বিকেলে বাড়ির পাশে একটি দোকানের ছাউনি থেকে বেরিয়ে এক বিষধর সাপ কামড় দেয় সাকিবুলকে। তবে ওই সময়ে ছেলেটি সাপের কামড়ের বিষয়টি বুঝতে পারেনি। পরে ব্যথা শুরু হলে স্থানীয় পল্লি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায় তার পরিবারের সদস্যরা। চিকিৎসক ক্ষত দেখে বুঝতে পারেন যে সাপে কামড়েছে। পরে অসুস্থ অবস্থায় তাকে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অ্যান্টিভেনম না থাকায় ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিতে বলা হয়। সেখানেও অ্যান্টিভেনম না থাকায় দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলে পথিমধ্যে ১০ মাইল নামক স্থানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সাকিবুল।
আক্ষেপ করে ইসরাইল উদ্দিন বলেন, ‘চারটা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। বালিয়াডাঙ্গী হাসপাতাল থেকে হরিপুর, এরপরে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতাল। সেখানেও ভ্যাকসিন (অ্যান্টিভেনম) না পেয়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ হাসপাতাল নিয়ে গেলাম; রাত তখন ১০টা বাজে। সেখানেও ভ্যাকসিন নেই। পরে দিনাজপুর মেডিকেলে নেওয়ার পথে আমার ছেলে আমার কোলে ওপর মারা গেল। বাবা হয়ে ছেলেকে বাঁচাতে পারিনি।’
আর যেন কোনো বাবার বুক খালি না হয়, এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন ইসরাইল উদ্দিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুলছাত্র সাকিবুলের মতো ঠাকুরগাঁও জেলায় গত দুই সপ্তাহে পীরগঞ্জের সপ্তম শ্রেণির স্কুলছাত্র তারেক, রাণীশংকৈলের কলেজছাত্র মোকসেদ আলী, হরিপুরে গৃহবধূ সম্পা রাণীসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বিষধর সাপের দংশনে।
নিহতদের স্বজনরা বলছেন, জেলা ও উপজেলার হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম না থাকায় প্রাণ হারাতে হচ্ছে এসব রোগীদের।
সম্পা রাণীর স্বামী জিতেন বলেন, ‘সকালে সাপে কামড়ানোর পর হরিপুর, রাণীশংকৈল এবং সবশেষ ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে নিয়ে গেছি, কিন্তু ভ্যাকসিন পাইনি। নিরুপায় হয়ে ওঝার কাছে নিয়ে যাই। এরপরেও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারিনি। দেড় বছরের একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।’
স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক আজমুল হক বলেন, ‘বর্ষার সময়ে প্রতি বছর ঠাকুরগাঁও জেলায় ১০ থেকে ১৫ জন ব্যক্তি সাপের কামড়ে মারা যায়। এজন্য হাসপাতালগুলো অ্যান্টিভেনমের চাহিদা পাঠায়। কিন্তু ভ্যাকসিন যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছায়, তখন বর্ষা শেষ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে বর্ষার আগেই অ্যান্টিভেনম মজুদ রাখা।’
ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. মো. আনিছুর রহমান অ্যান্টিভেনম না থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘চাহিদাপত্র পাঠানোর পরও ঢাকা থেকে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়নি। ঢাকা কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে অ্যান্টিভেনমের সংকট রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এর মধ্যেও আমরা কিছু অ্যান্টিভেনম সংগ্রহের চেষ্টা করছি।’