পুলিশ কর্মকর্তা বাবা বললেন, একজনকে মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার?

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় করা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আজও তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষীতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কাজলায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে শহীদ ইমাম হাসান তাইমের বড় ভাই রবিউল হাসান সাক্ষীতে বলেন, ‘আমার বাবা পুলিশের এসআই (উপপরিদর্শক) মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়া। আমার ছোট ভাইকে হত্যার পর বাবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, একজনকে মারতে কয়টা গুলি লাগে স্যার? আমার ছেলের কি দোষ ছিল? কেন তাকে এত কস্ট দিয়ে মারা হলো? কেন তার শরীরে দুইশ গুলি মারা হলো?’
আজ সোমবার (১৮ আগস্ট) বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষীর জবানবন্দি দেন শহীদ ইমাম হাসানের ভাই রবিউল হাসান। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আজ পর্যন্ত এ মামলায় ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।
ইমাম হাসান নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
সাক্ষীর জবানবন্দিতে শহীদ ইমাম হাসানের ভাই বলেন, আমার নাম রবিউল আওয়াল ভূঁইয়া। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। আমি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র। শহীদ ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া আমার ছোট ভাই।
সাক্ষী রবিউল হাসান বলেন, ‘২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ১৬ জুলাই পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চলে। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতিপুতি বলে আখ্যায়িত করে। ফলে আন্দোলন বেগবান হয়। আমি সিলেটে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। আমার ছোট ভাই ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত সে আন্দেলনে অংশগ্রহণ করে। আমার মা তার ব্যাগ নিয়ে কাছাকাছি বসে থাকত। ১৯ জুলাই রাতে সরকার কারফিউ জারি করে। ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। আমার ভাই মাকে চা খাওয়ার কথা বলে বাসার বাইরে যায় এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ঐ সময় তাকে আমি দুই বার কল দিয়েছি, কিন্তু সে রিসিভ করেনি। আনুমানিক দুপুর ১২টা ৩১ মিনিটের দিকে তার মোবাইলফোনে কল দিলে সেটি বন্ধ পাই। আনুমানিক দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে আম্মুকে ফোন দিলে আব্বু রিসিভ করে জানান, বাড়িওয়ালা মাকে বলেছে, তায়িম (ইমাম হাসান) গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আমার আম্মা ঘটনাস্থল, অর্থাৎ কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে তায়িমের জুতা ও রক্ত দেখতে পান। সেখানে থাকা লোকজন আমার মাকে জানায়, আপনার ছেলেকে ভ্যানে করে পুলিশ যাত্রাবাড়ী থানার দিকে নিয়ে গেছে।’
‘আমি তায়িমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে আমার খালা মোসা. শাহিদা আক্তারকে জানালে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যায়। সেখানে খোঁজাখুঁজির পর তায়িমকে না পেয়ে একজন সাংবাদিককে তায়িমের ছবি দেখালে তিনি বলেন, তাকে (তায়িম) মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে। পরের দিন আমার বাবা গিয়ে সেখান থেকে লাশ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যায়। আমি সিলেট থেকে কুমিল্লা গ্রামের বাড়িতে যাই। সেখানে ২১ জুলাই আনুমানিক রাত ১০টায় তার লাশ দাফন করা হয়। আমার আব্বার কাছ থেকে জানতে পারি, আমার ছোট ভাইয়ের শরীরে দুইশটির মতো ছররা গুলি লেগেছিল।’
আদালতের এক প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী রবিউল হাসান বলেন, তার বাবা পুলিশে চাকরি করেন।
সাক্ষী রবিউল হাসান আরও বলেন, ‘তায়িমের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, পুলিশ যখন টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলি করে, তখন সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তায়িম তার দুজন বন্ধুসহ লিটনের চায়ের দোকানে আশ্রয় নেয়। পুলিশ সেখান থেকে তাদের তিনজনকে টেনে বের করে এবং বেধড়ক মারধর করে। পুলিশ তাদেরকে গালি দিয়ে দৌড় দিতে বলে। তায়িম প্রথমে দৌড় দেয়। তখন তায়িমের পায়ে একজন পুলিশ সদস্য গুলি করে। সে পেছন ফিরে তাকালে তখন তার শরীরের নিম্নাংশে আরেকটি গুলি করা হয়। গুলিটি সামনের দিকে প্রবেশ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। তায়িমকে শটগান দিয়ে আরও অনেক গুলি করা হয়। তখন তার বন্ধু রাহাত তাকে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। তখন পুলিশ রাহাতকেও গুলি করে এবং তাকে বাধ্য করে তায়িমকে ফেলে রেখে যেতে। রাহাত চলে যাওয়ার পরও আধঘণ্টা পর্যন্ত তায়িম ওখানে পড়ে ছিল। তায়িম ওখানে পড়ে কাতরাচ্ছিল এবং আকুতি করছিল—আমাকে বাঁচান বাঁচান বলে। সাংবাদিকসহ উপস্থিত অনেকেই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তাকে নিতে দেয়নি। বরং তারা তার মৃত্যু উপভোগ করছিল। ওখান থেকে ২০ গজের মধ্যে রাস্তার দুপাশে দুটি হাসপাতাল ছিল। আধঘণ্টা পরে পুলিশ ভ্যানে করে তাকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিয়ে মাটিতে নামিয়ে পাঁচ-ছয়জন পুলিশ বুট দিয়ে তাকে মাড়িয়ে তার চেহারা বিকৃত করে ফেলে। তাদের মধ্যে ছিল এডিসি শামিম, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির ও এসি নাহিদ। পরে কেউ একজন তাকে ভ্যানযোগে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ডাক্তারা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
‘যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন সাব ইন্সপেক্টর সাজ্জাদুজ্জামান প্রথম পায়ে গুলি করে। পরে এডিসি শামিম আরেকজনের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তায়িমের শরীরের নিম্নাংশে গুলি করে। তারপর ওসি (তদন্ত) জাকির হোসেন অনেকবার গুলি করে। ঘটনাস্থলে তখন জয়েন্ট কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, জয়েন্ট কমিশনার প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি (অপারেশন) ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য ছিল’, যোগ করেন সাক্ষী রবিউল।
শহীদ ইমাম হাসানের ভাই রবিউল হাসান বলেন, ‘২৮ জুলাই আমরা প্রথমে পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের কাছে গিয়েছিলাম মামলা করার জন্য। তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। তারপর যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম, থানায় মামলা নেয়নি। সেখান থেকে আমাদেরকে ডিসি (ওয়ারী) ইকবালের অফিসে নিয়ে যায়। ডিসি আমাদের মামলা নেয়নি। তিনি বলেছিলেন, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে, যাতে আমরা রাজী হয়নি।’
জবানবন্দিতে রবিউল বলেন, ‘যাত্রাবাড়ির সে সময়ের কয়েকটি ভিডিওতে তায়িম ও ছাত্র-জনতার ওপর মুহুর্মুহু নৃশংসভাবে গুলি করতে দেখা যায়। আমার ভাইকে গুলি করা সংক্রান্ত ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করলাম। এই সেই পেনড্রাইভ (বস্তু প্রদর্শনী-VI)।’ ভিডিওটি ট্রাইব্যুনালে প্লে করা হয়। এ পর্যায়ে সাক্ষী কান্নায় ভেঙে পড়েন।
‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে আমার ভাইসহ আন্দোলনকারী প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আমি তাদের ফাঁসি চাই’, যোগ করেন রবিউল হাসান।