পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা হয় বিএনপির

পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘গণহত্যার’ নিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া, না চাওয়ার বিষয় আবারও জোরালোভাবে সমানে এসেছে। এই নিয়ে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী কৌশলী বক্তব্য দিয়েছেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানোর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনাসহ অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিকদলগুলো আলোচনা করে। তবে সেগুলো আগেই দু’দফায় সমাধান হয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি মন থেকে অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।
রোববার (২৪ আগস্ট) ঢাকায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পরিবারের মধ্যে, ভাইদের মধ্যে যখন এটার সমাধান হয়ে গেছে, এমনকি ইসলামও আমাদের বলেছে যে, তোমাদের হৃদয় পরিষ্কার করো। সুতরাং চলুন সামনে এগিয়ে যাই। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
তবে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর আগেই সমাধান হয়েছে বলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দাবি করেছেন, সেটির সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আলাদা আলাদা বৈঠক করেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যাসহ অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সর্ম্পক জোরদার করা নিয়ে আলোচনা হয়। সার্কের (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আমরা দুই দেশের পারস্পরিক বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করেছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গণহত্যার জন্য পাকিস্তান তো এখনো ক্ষমা চায়নি।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষাৎ করেছেন। উনার শারীরিক অবস্খার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। এখানে রাজনৈতিক কোনো আলোচনা হয়নি।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠকে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা বেড়েছে কিনা এটা নিয়ে বলার সময় এখনো হয়নি।
বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্ববাসীর আগ্রহ আছে। বিএনপির কাছেও কূটনৈতিকরা নির্বাচন সম্পর্ককে জানতে চায়। এটাকে আমরা ‘ইতিবাচক’ হিসেবেই দেখছি। একটি স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিএনপি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে এবং করে যাচ্ছে বলে কূটনৈতিক বৈঠকগুলোতে জানানো হচ্ছে।
সর্বশেষ পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহার দার বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পাকিস্তান দূতাবাসে বৈঠক করেন। সেখানে দুই দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বশেষ গত রোববার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার। এর আগে ২১ জুলাই বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভুটানের রাষ্ট্রদূত দাশো খারমা হামু দর্জি।
গত শনিবার (২৩ আগস্ট) দুইদিনের সফরে একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। ঢাকায় অবস্থানকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক বৈঠকে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেন তিনি।
ইসহাক দারের সঙ্গে পাকিস্তান দূতাবাসে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটি সদস্য ডক্টর আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিম রহমান, বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোববার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যা ৭টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসা ফিরোজায় এ স্বাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। ৪৫ মিনিট স্থায়ী এই সাক্ষাতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দারসহ ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল ছিলো এই সাক্ষাতে।
পরে অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, আপনারা জানেন— সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ, বাসায় আছেন। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করেছেন ও কুশল বিনিময় করেছেন। তিনি বলেন, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি মূলত এসেছিলেন। উনার আশু আরোগ্য কামনা করেছেন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের পক্ষে থেকে ম্যাডামকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন উপপ্রধানমন্ত্রী বলে জানান এজেডএম জাহিদ হোসেন।
সাক্ষাতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন, দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা ফোরাম সার্ককে শক্তিশালীসহ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, দেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা হয়নি। একজন আরেকজন কুশল বিনিময় করেছেন। ম্যাডামের সুস্থতার কামনা করেছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কূটনৈতিক, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বৈঠক করছেন। সম্প্রতি লন্ডনে একটি অভিজাত হোটেলে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও বিএনপি’র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার প্রসঙ্গে জানতে চান রাষ্ট্রদূত।
গত বছর ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে আমেরিকা, ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা বৈঠক করেছেন। পৃথক পৃথক এসব বৈঠকে জাতীয় নির্বাচন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।