বিনিয়োগকারীদের আস্থাসংকট, বাড়ছে শেয়ারশূন্য বিও

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। ফলে বেনিফিসিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব রয়েছে, কিন্তু একটাও শেয়ার নেই –এমন হিসাবের সংখ্যা বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন লাখ বেড়েছে।
২০১৪ সালের জুনে বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাবে শেয়ারের স্থিতি শূন্য এমন সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ২৬ হাজার ২১টি। তবে ২০১৫ সালের জুনে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ২০ হাজার ২৩৩টি।
স্থিতি শূন্য হিসাব বাড়ার বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ রশিদ লালী বলেন, মূলত একটি বিশেষ শ্রেণির বিনিয়োগকারীর চালু করা বিও হিসাব একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে স্থগিত হয়। মূলত দুটি কারণে চালু করা বিও হিসাব বন্ধের পরিমাণ বাড়তে পারে। একটি হলো- শুধু আইপিও আবেদনের জন্য নতুন হিসাব চালু করে দু-একটি আইপিও তে আবেদন শেষে তা আর নবায়ন না করা। আরেকটি হলো- সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার বিক্রয় করে নতুন শেয়ার না কেনা। যে হারে নতুন হিসাব বন্ধ হয়, সে হারে নতুন হিসাব না খোলার কারণেও এর পরিমাণ বাড়তে পারে। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থার অভাব দূর করা ছাড়া এটি সমাধানের কোনো উপায় নেই।
সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৫২টি। এর মধ্যে নিয়মিত শেয়ার লেনদেন হয় এমন বিও হিসাব ১৫ লাখ ৯১ হাজার ৫১৮টি এবং কোনো শেয়ারই নেই (স্থিতি শূন্য) এমন বিও হিসাব ১১ লাখ ২০ হাজার ২৩৩টি। হিসাব খোলার পর একবারও ব্যবহার হয়নি এমন হিসাব দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ১০১টি।
২০১৪ সালের ৩০ জুন মোট বিও হিসাব ছিল ২৯ লাখ ৫৮ হাজার ৩৫৩টি। এর মধ্যে সচল হিসাব ছিল ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৪৬টি এবং শূন্য শেয়ারধারী হিসাব আট লাখ ২৬ হাজার ২১টি।
২০১১ সালের জুন শেষে স্থিতি শূন্য বিও হিসাব ছিল ছয় লাখ ৮৭ হাজার ৩৫২টি, যা ২০১৫ সালের জুন শেষে দাঁড়ায় ১১ লাখ ২০ হাজার ২৩৩টি। গত পাঁচ বছরে এ হিসাব বেড়েছে চার লাখ ৩২ হাজার ৮৮১টি।
আনোয়ার সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপক সমীর কুমার সাহা বলেন, ‘২০১০ সালের পর থেকেই বিনিয়োগকারীদের লেনদেন কমেছে। বাজারের বর্তমান অবস্থার কারণে যারা একবার শেয়ার বিক্রি করছেন, তাঁরা আর কিনছেন না। ফলে তাদের বিও হিসাব শেয়ারশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আর নতুন করে তা নবায়ন না করায় এ ধরনের হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে। শেয়ারবাজারে পরিচালনযোগ্য বিও হিসাবের সংখ্যা কমে আসা ব্রোকারেজ হাউসের জন্য অশনি সংকেত। কারণ বিনিয়োগকারীদের লাভ-লোকসান নয়, শেয়ার হাতবদল হলেই আমাদের কমিশন আসে। বিও হিসাব কমায় লেনদেন কমছে, সেই সাথে আমাদের আয়ও কমছে।’
সমীর বলেন, ‘যারা শুধু বাজারে আইপিও কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য হিসাব খুলেছেন। এদের মধ্যে যারা আইপিও বাজারে ভালো মুনাফা করতে পারছেন না, কিন্তু বছর শেষে ফি দিতে হচ্ছে –এমন হিসাবগুলো মূলত একটি নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। আর যখন তারা মনে করেন আবারও বাজারে ব্যবসা করবেন তখন ফিরে আসেন। মূলত আইপিও বাজারের হিসাবগুলো এ সময় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত যারা বাজারে বিনিয়োগ করছেন তাঁদের হিসাবে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।’
সাধারণ বিনিয়োগকারী মোহাম্মদ হোসেন জানান, বাজারের দীর্ঘদিন শেয়ারের দর পতনের কারণে যারা অনেক আগে শেয়ার কিনেছিল তারা দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে কেনা দামের কাছাকাছি আসলেই তাঁর হাতের শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এতে একটা সময় শেষে তাঁর হিসাব স্থির হয়ে যাচ্ছে। আমার পরিচিত যারা সেকেন্ডারিতে ব্যর্থ হয়েও আইপিও নিয়ে আশাবাদি ছিল। আইপিওতে ধীরগতি দেখা দেওয়ায় তাদের অনেক হিসাব এখন আর সচল নেই। আইপিও বাড়লে আবারও পরিচালনযোগ্য হিসাবের পরিমাণ বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ডিপোজিটরি নিয়ম অনুযায়ী, বিও হিসাব পরিচালনার জন্য বিনিয়োগকারীকে নির্ধারিত হারে বার্ষিক হিসাবরক্ষণ ফি দিয়ে হিসাব নবায়ন করতে হয়।
বর্তমানে বিও হিসাব নবায়ন করতে ৫০০ টাকা ফি দিতে হয়। এর মধ্যে সিডিবিএল ১৫০ টাকা, হিসাব পরিচালনাকারী ব্রোকারেজ হাউস ১০০ টাকা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ৫০ টাকা ও বিএসইসির মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে ২০০ টাকা জমা হয়।
সিডিবিএল সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি হিসাব নবায়ন করার ক্ষেত্রে প্রতি বছর জুন মাসকে লক্ষ্য ধরা হয়। জুনে নবায়ন না হওয়া বিও হিসাবকে সিডিবিএল স্থগিত বা বন্ধ করে দেয়। ব্রোকারেজ হাউস থেকে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সিডিবিএলে এ বন্ধের তালিকা পাঠানো হয়। আর এ ক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগকারীদের ২৫ জুন পর্যন্ত সময় দেয়।
সিডিবিএলের হিসাব অনুযায়ী মোট বিও হিসাবের প্রায় অর্ধেকই এখন বন্ধ বা লেনদেনশূন্য। নতুন হিসাব খোলার চেয়ে হিসাবের নবায়ন বন্ধ এবং শেয়ার শূন্যতা বাজারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। কারণ এর ফলে একদিকে সিকিউরিটি হাউস ও বাজারসংশ্লিষ্টদের আয় কমবে। অন্যদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে দূরে সরে যাবে।
২০১১ সালের জুনে একবারও শেয়ার লেনদেন হয়নি এমন হিসাবের সংখ্যা ছিল ছয় লাখ ৫০ হাজার ৬১১টি। পরের বছর এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৮৭১টি। ২০১৩ এর জুনে আরো কমে দাঁড়ায় দুই লাখ ৩৯ হাজার ৩৩৫টি। কিন্তু এর পরের বছর থেকে আবারো বাড়াতে থাকে। ২০১৪ সালের জুনে এর পরিমাণ দাঁড়ায় চার লাখ ৪৩ হাজার ৮৬টি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুন শেষে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৮৪ হাজার ১০১টি।