কোথায় কীভাবে কাদের কাছে গেল বাংলাদেশের টাকা

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার কোথায় কীভাবে গেল এই নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যম এবিএস-সিবিএন অনলাইন। বিরাট এ পাচারের পুরো গতিপথটি তুলে ধরা হলো এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য।
ঘটনার শুরু ২০১৫ সালের ২১ মে। সেদিন ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) মাকাতি জুপিটার শাখার ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো চার ব্যক্তির সঙ্গে ব্যাংকে হিসাব খোলার ব্যাপারে স্থানীয় এক হোটেলে দেখা করেন। তার পরদিন এনরিকো তিয়োদরো ভাসকুইজ, আলফ্রেড সানতোস ভারগারা, মাইকেল ফ্রান্সিসকো ক্রুজ এবং জেসি ক্রিস্টোফার লার্গোসের নামে চারটি হিসাব খোলা হয়। এই চারজনকে শনাক্ত করেছিলেন আরসিবিসি ব্যাংকের পুরোনো হিসাবধারী কিম সিন ওয়ং (কিম ওয়ং)।
পরে মায়া সান্তোস দেগুইতো বলেছেন, মিদাস হোটেলে সেই বৈঠকে কিম ওয়ংই হিসাবগুলো খোলার জন্য পাঁচ ব্যক্তির নাম ও তথ্য দেন। দেগুইতো তাঁদের পরিচয়পত্র যাচাই করেন। পরে তাঁর কাছে এসব হিসাব খোলার জন্য আড়াই হাজার ডলার পাঠানো হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ওই চারটি হিসাবে আর কোনো লেনদেন হয়নি।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি একই দিনে সুইফট ম্যাসেজ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের অর্থ চুরি করে একদল হ্যাকার। এবিএস-সিবিএন অনলাইনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থ হাতানোর পর একই দিনে শ্রীলঙ্কার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) হিসাবে ২০ মিলিয়ন এবং আরসিবিসি ব্যাংকের প্রধান শাখায় ৮১ মিলিয়ন ডলার পাঠানো হয়।
আরসিবিসি ব্যাংকে পাঠানো বিপুল এ অর্থের মধ্যে ভাসকুইজের হিসাবে ২৫ মিলিয়ন, ভারগারার হিসাবে ১৯.৯৯ মিলিয়ন, এবং ফ্রান্সিসকো ক্রুজ এবং লার্গোসের হিসাবে যথাক্রমে ৬ এবং ৩০ মিলিয়ন ডলার জমা করা হয়। এরপর ৫ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই চারটি হিসাবের পুরো টাকা উঠিয়ে নেয় ওই চার হিসাবধারী।
এরই মধ্যে আরসিবিসির চারটি হিসাবে আট কোটি ১০ লাখ ডলার পৌঁছার পর সেগুলো অন্যান্য ব্যাংক হিসাবে পাঠানোর আগে পেসোতে রূপান্তরের জন্য মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ফিলরেমকে ব্যবহার করতে দেগুইতোকে নির্দেশ দেন ওয়ং।
পরে ৩৫.২ মিলিয়ন ডলার তুলে স্থানীয় মুদ্রা পেসোয় রূপান্তর করা হয়। বাকি ৪২.৯৩ মিলিয়ন ডলার চলে যায় ব্যবসায়ী উইলিয়াম গোর হিসাবে।
পরে অবশ্য ডলার পাচার এবং নকল ব্যাংক হিসাব খোলার দায় আরসিবিসির ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোর ওপর দোষ চাপান ব্যবসায়ী ও অন্যতম সন্দেহভাজন উইলিয়াম সো গো। তিনি বলেন, তিনি অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত নন। বরং তাঁর নামে একটি ব্যাংক হিসাব খুলতে দেগুইতো তাঁর স্বাক্ষর জাল করেছেন।
এরই মধ্যে ৮ ফেব্রুয়ারি সন্দেহভাজন চারটি হিসাবের লেনদেন বন্ধ করতে আরসিবিসির কাছে অনুরোধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু চীনা চন্দ্রবর্ষের ছুটিতে ব্যাংক বন্ধ থাকায় তখনই এই অনুরোধ রাখতে পারেনি আরসিবিসি কর্তৃপক্ষ। এই সময়ের মধ্যে সন্দেহভাজন চারটি হিসাব থেকে সব টাকা তুলে ফেলা হয়।
এদিকে উইলিয়াম গোর হিসাবেও থাকেনি এই অর্থ। দ্রুতই বিভিন্ন দিকে চালান হয়ে যায়। ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি মধ্যে প্রথমে ক্যাগায়ান প্রদেশের সোলায়ার রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনো এবং ওয়েকাং জো ক্যাসিনোতে ঢোকে ৩০.৬৩৯ মিলিয়ন ডলার। আরো প্রায় দুই কোটি ১৩ লাখ ডলার ঢোকে ইস্টার্ন হাওয়াই ক্যাসিনো অ্যান্ড রিসোর্টে। বাকি প্রায় দুই কোটি নব্বই লাখ ডলার ব্লুমবেরি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে ঢোকে।
আর জুয়ার আসরে এই টাকা ঢোকার পর সুকৌশলে এই টাকাগুলোকে হেরে যাওয়া টাকা হিসেবে দেখিয়ে বাজার থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে এই টাকাগুলো কোথায় গেছে তা আজও বের করতে পারেনি ফিলিপাইনের তদন্ত কমিটি।
এদিকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে ক্যাসিনোর মালিকরা জানিয়েছেন, বড় জুয়াড়িদের জন্য এসব ক্যাসিনোতে বাকিতে চিপস [বাজির টিকিট] কেনার সুবিধা রয়েছে। রিজল ব্যাংকের সেই সন্দেহভাজন হিসাবগুলোর টাকা জুয়াড়িদের হিসাবে জমা হওয়ার আগেই বাকির সুবিধা নিয়ে তাঁরা খেলতে শুরু করেছিলেন।
ফিলিপাইনের আইন অনুযায়ী ক্যাসিনোতে জুয়ায় জেতা অর্থ থেকে নির্ধারিত ট্যাক্স দিলে তা বৈধ আয় বলে বিবেচিত হয়। সেভাবেই ওই টাকা হাতবদল হয়ে পাচার হয়ে গেছে বলে তদন্তকারীদের ধারণা।
উপরন্তু এই ঘটনার তদন্তে থাকা সিনেট ব্লু রিবন কমিটির প্রধান সিনেটর তিওফিস্তো গুইঙ্গনা এবং সিনেটর সার্জিও ওসমেনা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চুরি যাওয়া ৮০০ কোটি টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই টাকা এরই মধ্যে ‘কালো গহ্বরে’ হারিয়ে গেছে। সেখান থেকে এ অর্থ উদ্ধারের আশা খুবই ক্ষীণ।