চায়ের নতুন ভুবন গারো পাহাড়

পঞ্চগড়ের পর এবার শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকা হতে যাচ্ছে চা চাষের জন্য নতুন আরেকটি ক্ষেত্র।
চা বোর্ড থেকে সেখানকার মাটিকে চা চাষের উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এরই মধ্যে কৃষকরা সেখানে চা চাষ শুরু করে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন একজন শিল্প উদ্যোক্তা।
ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শেরপুরের গারো পাহাড়ে নেমে আসা হাতি কৃষকের পাকা ধান নষ্ট করে ফেলে। কৃষক আবারও ধান লাগান। আবারও হাতি এসে তা নষ্ট করে দেয়। এমন এক অদ্ভুতচক্রে অনিশ্চিত হয়ে আছে এখানকার জীবন। এই বাস্তবতায় কৃষকরা ধানের বিকল্প হিসেবে চা চাষের কথা বলছেন, যা হাতির খাবারের মধ্যে পড়ে না।
গারো পাহাড় এলাকার কৃষকরা বলছেন, ‘হাতি চাষ করা সম্পূর্ণ ধান খেয়ে চলে যায়। হাতির অত্যাচারে ধান চাষ করা সম্ভব হয় না। চা বাগানে কাজ করলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়। আমরা কাজ করে খেতে পারব। হাতি চা খেতে পারবে না। ফলে চা চাষের জন্য কোনো অসুবিধা নেই।’
এখানে চা চাষের আলোচনাটি বেশ পুরোনো। এ এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা জেলায় একই মাটিতে বেশ আগে থেকেই চা চাষ হচ্ছে। তবে চা চাষের পক্ষে জোরালো দাবি উঠেছে তখন থেকেই, যখন এ অঞ্চলের মাটিকে চা চাষের উপযোগী ঘোষণা করা হয়।
১৪ বছর আগে চা বোর্ডের যে দলটি এখানে মাটি পরীক্ষার জন্য এসেছিল, সেই দলের একজন সদস্য জানান, চা চাষ হওয়া সিলেটের মাটির সঙ্গে গারো পাহাড়ের মাটির যথেষ্ট মিল রয়েছে।
গারো পাহাড়ের মাটি পরীক্ষার দলের সদস্য এম এ খালেক বলেন, ‘চা চাষের জন্য প্রয়োজন বেলে-দোআঁশ মাটি। এই গারো এলাকায় বেলে-দোআঁশ মাটি রয়েছে। তাই এলাকাটি চা চাষের জন্য উপযোগী।’
১৪ বছর আগে গারো পাহাড়ের মাটিকে চা চাষের উপযোগী ঘোষণা করা হলেও উদ্যোক্তার অভাবে এখানে চা প্রক্রিয়াজাতের জন্য কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি।
আশার ব্যাপার হলো, গারো হিলস টি কোম্পানির ব্যানারে একজন উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন। তাঁর নাম আমজাদ হোসেন ফনিক্স। তিনি এলাকার কয়েকজন চাষিকে নিয়ে গিয়েছিলেন পঞ্চগড়ে। পঞ্চগড়ে চা চাষ করে কীভাবে কৃষকের ভাগ্য বদলে গেছে, তা দেখে আসার পর থেকেই বিষয়টি খুব দ্রুত অন্য কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
পঞ্চগড়ে চা চাষ দেখে এসে একজন কৃষক বলেন, ‘পঞ্চগড়ে যে ৫০টা চারা পেরেছে, সে সেটাই লাগিয়েছে। সেখানে খালি চা গাছ আর চা গাছ। আমাদের মালিক গাড়িতে করে তেঁতুলিয়া, জিরো পয়েন্টসহ আরো কয়েকটি জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ওই এলাকাগুলোতে চা চাষ করে অনেকেই লাভবান হয়েছেন। সেখানে চা চাষ করে অনেকেই নিজ নিজ বাড়িঘর বানিয়েছেন।’
ক্ষুদ্র চা চাষী উন্নয়ন কমিটি গঠন করে সেখানে এরই মধ্যে নিবন্ধন করেছেন ঝিনাইগাতি, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলার কয়েকশ কৃষক। তাঁরা নিজেদের জায়গায় যত্ন নিয়ে বড় করছেন চা গাছ।
গারো হিলস টি কোম্পানির উদ্যোক্তা ফনিক্স চা চারার জন্য একটি নার্সারি প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু চা চাষী উন্নয়ন কমিটি বলছে, এটি চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।
ক্ষুদ্র চা চাষী উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, পঞ্চগড় থেকে কাটিং নিয়ে এসে দুই লাখ চারা লাগানো হয়েছে। কিন্তু দুই লাখ চারা দিয়ে হবে না। কমপক্ষে ২০ লাখ চারার প্রয়োজন।
এসব নানা চ্যালেঞ্জ আর প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছেন এখানকার চা শিল্পের উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন ফনিক্স। তিনি বলেন, ‘অনেক মাইগ্রেটেড হাতি এখানে এসে শর্টটার্ম ক্রপগুলো নষ্ট করে। যদি চা বাগান করা যায়, তাহলে তা এখানকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনেক কার্যকরী হবে। এটা অনেক শক্তিশালী ক্রপ এবং লং টার্ম।
ঢাকা থেকে এসে দুই বছরের জন্য গারো পাহাড়ে পড়ে রয়েছেন ফনিক্স। তাঁর উদ্দেশ্য একটাই, যেন তাঁর হাত ধরে গারো পাহাড়ে চা চাষের বিপ্লব ঘটে।
চা শিল্পের এই উদ্যোক্তা আরো বলেন, ‘এক একর জমিতে দুই বছর পর থেকেই সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা পাওয়া সম্ভব। আর চার-পাঁচ বছরের মাথায় ১০ লাখের কমবেশি টাকা পাওয়া যাবে। সে জন্য একজন কৃষক অবশ্যই লাভবান হবে। বিষয়টি সম্পর্কে পঞ্চগড়ের মতো এখানকার মানুষও যখন জানতে পারবে, তখন এখানে একটি বিপ্লব হবে।’
সিলেটের প্রকৃতি এবং মাটির সঙ্গে শেরপুরের গারো পাহাড়ের অনেক মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। যে কারণে এ অঞ্চলটিকে চা চাষের জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন চা চাষি ও উদ্যোক্তাদের সব ধরনের সমর্থন দেওয়া। আর তাতেই হয়তো অবহেলিত এই জনপদের ভাগ্য পাল্টে যেতে পারে।