ডলার ও সুদের হার নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি কাজে আসবে?
![](http://103.16.74.218/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2024/05/11/dollar-afp.jpg)
একইসঙ্গে বাজারভিত্তিক সুদের হার ও ডলারের বিনিময় হার ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতিতে নির্ধারণের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে বুধবার ব্যাংকের সুদহার ও ডলারের দাম বেড়ে যায়। ডলারের দাম এখন ১১০ টাকা থেকে এক লাফে ১১৭ টাকা হয়েছে। সুদহার ক্ষেত্রভেদে এক টাকাও বেড়েছে। সর্বশেষ ব্যংক ঋণের সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
ব্যাংকের সুদহার বাজারভিত্তিক করায় ব্যাংকগুলো নিজেরাই ঋণ এবং আমানতের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকও নীতি সুদের হার (রেপো) বাড়িয়েছে। ফলে ব্যাংগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে বেশি সুদ গুনতে হবে। মূলত আইএমএফের শর্ত মেনেই বাংলাদেশ ব্যাংক এই সংস্কার করেছে। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য তাদের তৃতীয় কিস্তির ঋণ ছাড়ের নিশ্চয়তা দিয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তুগুলোর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এতদিন ডলারের বিনিময় হার অফিসিয়ালি কম রাখা হয়েছিল। এখন তা বাস্তব পরিস্থিতির কাছাকাছি গেছে। সুদের হার বাজারভিত্তিক হওয়াই বাস্তবসম্মত। এটা চাহিদা ও জোগানের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।
গত ৯ মাস ধরে ব্যাংকের সুদের হারের জন্য ‘স্মার্ট পদ্ধতি’ চালু ছিল। তখন ‘সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল’ ভিত্তিক সুদ নির্ধারণ করা হতো। এখন যে বাজারভিত্তিক সুদহার চালু হলো, ২০২০ সালের এপ্রিলের আগেও তা ছিল। তবে এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এই হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছিল।
ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে বিনিময় হার নির্ধারণের ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি চালুর অংশ হিসেবে। ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ভাসমান বিনিময় হারের আগের ধাপ। এই পদ্ধতিতে ঊর্ধ্ব বা নিম্নসীমা নির্ধারণ করা থাকে না। মধ্যসীমা থাকে। তার আশপাশে ডলারে বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে যদি পদ্ধতিগুলো ঠিক মতো কাজ করে, তাহলে সাময়িক কষ্ট হলেও পরিস্থিতি পরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত এবং রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ডলারের দাম বাড়ায় রপ্তানিকারকরা লাভবান হবে। আর আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। রপ্তানিকারকরা টাকার হিসেবে বেশি অর্থ পাবেন। আর আমদানিকারকদের বেশি টাকায় ডলার কিনে আমদানি করতে হবে।’
‘কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেসরকারি খাতে যারা আমদানি করেন তারা ১১০ টাকায় ডলার কোথাও পেতেন না। ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তাদের কৌশলে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায়ই ডলার কিনতে হতো। ফলে আমদানি খরচ যে বেড়ে যাবে, তা কিন্তু নয়’, বলেন সিদ্দিকুর রহমান। তবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে শিল্প-কারখানা করেন, ব্যবসা করেন, তাদের খরচ বেড়ে যাবে।’
সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এতদিন ডলারের বিনিময় হার, ব্যাংকের সুদের হার এগুলো কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে রাখা হয়েছে। এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটাই সঠিক পদ্ধতি। কৃত্রিমভাবে কিছু ঠিক করা যায় না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমদানি ব্যয় ও উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সম্পর্ক আছে। এতদিন ডলারের যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেট ১১০ টাকা ছিল সেই রেটেই সরকারি আমদানি বা ব্যয় হতো। এখন জ্বালানি তেল, এলএনজি, সারসহ আরও যেসব পণ্য সরকার আমদানি করে, তার আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। তাৎক্ষণিকভাবে বেসরকারি খাতে আমদানিতে প্রভাব না পড়লেও সরকারি আমদানিতে প্রভাব পড়বে, যার চেইন রিঅ্যাকশন বাজারেও পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়বে, কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে, পরিবহণ ব্যয় বাড়বে। আর সুদের হার বাড়ার কারণে শিল্পে বিনিয়োগ কমতে পারে।
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘সুদের হার বাজারভিত্তিক হওয়া ঠিক আছে। এতে তারল্য সংকট কমবে। আবার ডলারের বিনিমহার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমম্বয় করাও ঠিক আছে। কিন্তু এইসব সংস্কারের প্রাথমিক ধাক্কা আছে। আর তা হলো মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়া। আবার সুদের হার বাড়ায় দেশি বিনিয়োগ কম হলে বেকারত্ব বাড়তে পারে। শিল্প উৎপাদন কমতে পারে। ডলারের দাম বাড়ার কারণে লাভবান হবেন রপ্তানিকারকরা।’
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অবশ্য ডলারের ক্রলিং পেগ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘ডলারের মধ্যবর্তী বিনিময় হার বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিয়েছে। কিন্তু ক্রল করে কোথায় উঠতে পারবে এবং কেথায় নামতে পারবে তা বলা হয়নি। ফলে এখানে অস্পষ্টতা আছে। এটা ভাসমান পদ্ধতি নয়। বিশ্বের দুটি দেশে এই পদ্ধতি আছে—ভিয়েতনাম ও নিকারাগুয়ায়। ভিয়েতনামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন ডলারের বিনিময় হার ঘোষণা করে। তার চেয়ে পাঁচ শতাংশ কম বা বেশিতে অন্যরা বিনিময় করতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে সেটা এখনও করা হয়নি। বাংলাদেশে যেটা হলো, সেটা ডলারের বিনিময় হার বাস্তবের কাছাকাছি নেওয়া হলো। কিন্তু এখন এই হারের বাইরে কেউ বিক্রি করতে পারবে না। ফলে ডলারের অবৈধ বাজার গড়ে ওঠার আশঙ্কা আছে। আগে ১১০ টাকা রেট হলেও বাইরে তারা বেশি দামে বেচা-কেনা করতে পারত, কোনো বাধা ছিল না। আসলে দরকার ছিল ভাসমান বিনিময় হার করা।’
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এতে সরকারি আমদানি ব্যয় বাড়লেও বেসরকারি আমদানি ব্যয় বাড়বে না। এখন কেউ যদি বাজার নিয়ে কারসাজি করতে চায়, সেটা আলাদা কথা।’
ড. জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে। রপ্তানিকারকরা লাভবান হবে। রিজার্ভ বাড়তে পারে।’
‘ব্যাংকে সুদের হার এখন বাজারভিত্তিক করায় এখন ঝুঁকিভিত্তিক ঋণের বণ্টন হবে। যেখানে ঝুঁকি বেশি, সেখানে সুদ বেশি হবে, যেখানে কম, সেখানে কম হবে। আসলে যেটা করা হয়েছে সেটা যৌক্তিক’, যোগ করেন ড. জাহিদ হোসেন।
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সবার যেটা আশঙ্কা যে এর ফলে ব্যবসায় ঋণের খরচ, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে কিনা, আসলে সেটা নির্ভর করে পুরো অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর। সেগুলোর স্বাস্থ্য ভালো থাকলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বাজারভিত্তিক সুদের হার বাংলাদেশে ২০০৯ সালের আগেও ছিল। এটা নতুন কিছু নয়। এখন আমানতকারীরা আগের চেয়ে সুদ বেশি পাওয়ায় ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে উৎসাহী হবেন। এতে তারল্য সংকট কমবে।’
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের ডলারের আমদানি বাড়াতে হবে। তাহলে রিজার্ভ বাড়বে। এখন সেজন্য টাকার চাহিদা বাড়াতে হবে। টাকার চাহিদা বাড়লে ডলারের রিজার্ভ বাড়বে। ডলারের বিনিময় হার এবং ব্যাংকের সুদের হার ভালো হলে এই দুটির প্রতিক্রিয়ায় রিজার্ভ বাড়ে। তবে এর জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এখন যে ক্রলিং পেগ করে ডলারে দাম ১১৭ টাকা করা হলো, এটা ক্রমান্বয়ে বাড়বে। একপর্যায়ে স্থিতিশীল হবে। তবে এতে মূল্যস্ফীতি প্রাথমিকভাবে বাড়লেও পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কারণ, রিজার্ভ বাড়লে তখন আমাদের ডলারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।’
‘অন্যদিকে ব্যাংকের বাজারভিত্তিক সুদের কারণে আমানত বাড়বে। তারল্য সংকট কমবে। আর যারা ঋণ নেবেন, তাদের হিসাব করে নিতে হবে। টাকার কস্টিং বেড়ে গেল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা নিতে হলেও ব্যাংকগুলোকে বেশি সুদ দিতে হবে। ফলে ব্যবস্থাপনার উন্নতি হবে’, যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আসলে সুদের হার বলেন আর ডলারের বিনিময় হার বলেন, এটা বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে চলবে। আমরা যেহেতু এটা এতদিন কৃত্রিমভাবে ম্যানেজ করেছি, তাই প্রাথমিকভাবে মূল্যস্ফীতিসহ আরও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকলে শেষ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করি।’