প্রাইজবন্ড কি? কোথা থেকে কিনবেন ও ভাঙাবেন? কেনার সুবিধা-অসুবিধা

আর্থ-সামাজিক জীবনধারায় প্রাইজবন্ড একটি পরিচিত নাম। এটি অনেকের কাছে সঞ্চয়ের নিরাপদ মাধ্যম এবং একই সঙ্গে ভাগ্য পরীক্ষা করার এক দারুণ সুযোগ। বিনিয়োগ, উপহার কিংবা দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদের কাছে এটি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তাই প্রাইজবন্ড কেনা ও ভাঙানোর নিয়ম, এর সুবিধা ও অসুবিধা, প্রাইজবন্ডের লটারী ও পুরুষ্কার সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি। চলুন, প্রাইজবন্ডের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
প্রাইজবন্ড কি
বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের একটি বিশেষ বিনিয়োগ প্রকল্প প্রাইজবন্ড। এখানে বিনিয়োগকারী যেকোনও সময় বিনিয়োগ করতে পারেন এবং প্রয়োজনে বন্ড ফেরত দিয়ে মূলধন তুলে নিতে পারেন। তবে এই প্রকল্প থেকে সরাসরি কোনও মুনাফা বা সুদ দেওয়া হয় না।
প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময় অন্তর লটারির মতো ‘ড্র’ অনুষ্ঠিত হয়। সেই ড্র-এর মাধ্যমে বিজয়ীরা বিভিন্ন মূল্যমানের পুরস্কার পান। সাধারণত বছরে চারবার ড্র আয়োজন করা হয়, এবং তার দিনক্ষণও নির্দিষ্ট- ৩১ জানুয়ারি, ৩০ এপ্রিল, ৩১ জুলাই, এবং ৩১ অক্টোবর। এই তারিখগুলোর কোনওটি সরকারি ছুটির দিনে পড়লে সেই ড্র পরবর্তী কার্যদিবসে অনুষ্ঠিত হয়।
সব বিক্রিত বন্ড একসঙ্গে ড্র-এর আওতায় আসে না। নির্দিষ্ট ড্র অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখের কমপক্ষে দুই মাস আগে যে বন্ড বিক্রি হয়েছে, শুধুমাত্র সেগুলোই ড্র-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ, কোনও বন্ড কেনার পর অন্তত দুই মাস অতিক্রম না হলে সেটি লটারিতে অংশ নিতে পারবে না।
ড্র অনুষ্ঠিত হয় সরকার অনুমোদিত স্থানে। এর আয়োজন ও পরিচালনায়ও থাকে সরকার কর্তৃক গঠিত বিশেষ কমিটি। ড্র-এর নিয়ম একক ও সাধারণ পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়, যেখানে প্রত্যেক সিরিজের জন্য একই নম্বর প্রযোজ্য হয়। বাজারে শুধুমাত্র চলমান প্রাইজবন্ড সিরিজগুলো ড্র-এর অংশ হয়।
প্রাইজবন্ড কেন কিনবেন: এর সুবিধা কি
অনেকেই প্রাইজবন্ডকে লটারির সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু এ দুয়ের মাঝে রয়েছে সুক্ষ্ম পার্থক্য। লটারিতে একবার ড্র শেষ হয়ে গেলে সেই টিকিটের কোনও মূল্য থাকে না। টিকিটে জিততে না পারলে পুরো টাকাই হারাতে হয়। কিন্তু প্রাইজবন্ডে বিষয়টি ভিন্ন। একটি ড্র শেষ হয়ে গেলেও বন্ডের মেয়াদ শেষ হয় না। পরবর্তী ড্র’তেও সেটি অংশ নিতে পারে। তাই একবার বন্ড কিনলে তা দিয়ে একাধিকবার ড্র’তে অংশ নেয়ার সুযোগ থাকে।
প্রাইজবন্ডের আরেকটি দিক হলো- এতে কোনও মাসিক সুদ বা লভ্যাংশ নেই। কারণ প্রাইজবন্ড বিক্রির মাধ্যমে সরকার আসলে জনগণের কাছ থেকে সরাসরি ঋণ সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে গ্রাহক বন্ড ফেরত দিলে সরকার সেই ঋণ শোধ করে। অর্থাৎ এটি সুদভিত্তিক সঞ্চয় নয়, বরং একটি নিরাপদ বিনিয়োগ যা আবার যেকোনও সময় ভাঙানো যায়।
যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে সরাসরি নগদ অর্থ উপহার দেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই বিব্রতকর। সেখানে প্রাইজবন্ড একটি উৎকৃষ্ট উপায়। যেমন- বিয়েতে উপহার হিসেবে প্রাইজবন্ড দিলে নবদম্পতি চাইলে তা সঙ্গে সঙ্গে ভাঙাতে পারেন। আবার চাইলে তারা বহু বছর রেখে দিয়ে ভবিষ্যতের ড্র-তে ভাগ্য পরীক্ষা করতে পারেন। এতে এক ধরনের স্বাধীনতা থাকে।
শুধু বিয়েতেই নয়, জন্মদিন, শিশুর মুখে ভাত কিংবা অন্য যেকোনও পারিবারিক অনুষ্ঠানে প্রাইজবন্ড অর্থবহ উপহার হতে পারে। এর মাধ্যমে উপহারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভবিষ্যতে বাড়তি সম্ভাবনারও সুযোগ পান। তাই এটি বিনিয়োগ, সঞ্চয় এবং উপহার- সবক্ষেত্রেই একটি কার্যকর বিকল্প।
প্রাইজবন্ডের পুরষ্কার
একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো পদ্ধতিতে প্রাইজবন্ডের পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে। এটি পূর্বনির্ধারিত এবং প্রতিটি সিরিজের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। কোন স্তরের পুরস্কারের জন্য প্রতিটি সিরিজ থেকে কতজন বিজয়ী হবেন- তা পুরস্কার ঘোষণার সময় স্পষ্টভাবে জানানো হয়।
প্রথম পুরস্কারের জন্য ৬ লাখ টাকা নির্ধারিত। ড্র-এর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট নম্বর বাছাই করা হয়। তবে প্রতিটি সিরিজে সেই একই নম্বরের বন্ডধারী একজন করে এই পুরস্কার পান। বর্তমানে ৮২টি সিরিজ চালু রয়েছে। ফলে একটি নম্বর নির্বাচিত হলে মোট ৮২ জন প্রথম পুরস্কার পান।
একই নিয়মে দ্বিতীয় পুরস্কারের পরিমাণ ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এখানেও প্রতিটি সিরিজ থেকে একজন করে বিজয়ী নির্বাচিত হন। অর্থাৎ মোট ৮২ জন এই পুরস্কার পাবেন।
তৃতীয় পুরস্কারের জন্য প্রতিটি সিরিজ থেকে দুটি করে নম্বর নির্বাচন করা হয়। পুরস্কারের পরিমাণ এক লাখ টাকা। তাই মোট বিজয়ীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬৪ জন।
চতুর্থ পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রতিটি সিরিজ থেকে দুটি করে নম্বর বাছাই করা হয়। এখানে পুরস্কারের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা। তাই মোট বিজয়ী হন ১৬৪ জন।
সবচেয়ে বেশি বিজয়ী নির্ধারিত হয় পঞ্চম পুরস্কারের ক্ষেত্রে। প্রতিটি সিরিজ থেকে ৪০টি নম্বর নির্বাচন করা হয়। পুরস্কারের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা। ফলে মোট ৩ হাজার ২৮০ জন বিজয়ী হন। সব মিলিয়ে প্রতি ড্র-তে মোট ৩ হাজার ৭৭২টি পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্রাইজবন্ড কোথা থেকে কিনবেন
সরকারের নির্দিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইজবন্ড কেনা বা ভাঙানোর কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করে থাকে। ময়মনসিংহ শাখা ব্যতীত বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যালয়ে প্রাইজবন্ড পাওয়া যায়। এ ছাড়াও যে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বন্ড কেনা যায়, সেগুলো হলো:
– শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো বাদে দেশের সব তফসিলি ব্যাংক
– জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীনস্থ সঞ্চয় ব্যুরো অফিস
– ডাকঘর
ক্রেতাকে শুধু নগদ অর্থ নিয়ে উপস্থিত হতে হয়। আলাদা কোনও আবেদনপত্র জমা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
পুরস্কারের অর্থ পাওয়ার জন্য আবেদনের নির্ধারিত নিয়ম রয়েছে। বিজয়ীকে মূল প্রাইজবন্ডসহ ফর্ম পিবি-২৩ সঠিকভাবে পূরণ করতে হয়। অতঃপর তা বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কোনও কার্যালয় (ময়মনসিংহ বাদে) সহ উপরোল্লিখিত যেকোনও প্রতিষ্ঠানে জমা দিতে হয়। সাধারণত আবেদন করার তারিখ থেকে দুই মাসের মধ্যে পুরস্কারের টাকা প্রদান করা হয়। প্রাপকের ব্যাংক হিসাবে সরাসরি সেই অর্থ জমা হয়। একইভাবে এসব কার্যালয় থেকে প্রাইজবন্ড ভাঙানোও যায়।
প্রাইজবন্ডের নেতিবাচক দিক
সুবিধার পাশাপাশি প্রাইজবন্ডের কিছু সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধাও রয়েছে। সেগুলো হলো:
– প্রাইজবন্ডের ড্র-তে জেতার সম্ভাবনা খুবই কম। বিনিয়োগ করে পুরস্কার পাওয়া সম্পূর্ণ ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। এটি আসলে কোনও দ্রুত লাভের উপায় নয়। স্বল্পমেয়াদি মুনাফার আশায় প্রাইজবন্ড কিনলে হতাশা আসতে পারে। বছরান্তে প্রাইজবন্ডের যে লভ্যাংশ দেওয়া হয় তার হার মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক ডিপোজিটের তুলনায় এটি অনেক কম।
– লভ্যাংশের হার এমনিতেই কম, তার উপর পুরস্কারের অর্থের উপর আয়কর দিতে হয়। আয়কর আইন ২০২৩-এর ১১৮ ধারা অনুযায়ী পুরস্কারের অর্থের উপর আরোপিত উৎসে কর ২০ শতাংশ।
– নকল টাকা শনাক্তে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলেও নকল প্রাইজবন্ড ধরা অত্যন্ত কঠিন। এতে ক্রেতারা প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
– পুরস্কার তুলতে গেলে অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয়। সঠিকভাবে ফরম পূরণ করা এবং গেজেটেড অফিসার দ্বারা সত্যায়ন করা বাধ্যতামূলক। এতে সময় বেশি লাগে এবং ভোগান্তিও পোহাতে হয়।
– সময়ের সাথে সাথে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে ১০০ টাকা মূল্যের প্রাইজবন্ডের প্রকৃত মূল্য আগের তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। দশ বছর আগে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ জিনিস কেনা যেত, এখন একই টাকায় তা সম্ভব নয়।
প্রাইজবন্ড লটারীর ফলাফল জানার উপায়
প্রাইজবন্ডের ড্র–এর ফলাফল চেক করার জন্য রয়েছে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট। এখানে প্রতিটি ড্র–এর বিজয়ীর সিরিজ ও নাম্বারের তালিকা প্রকাশ করা হয়। এছাড়া প্রাইজবন্ড সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব একটি পোর্টাল রয়েছে- https://prizebond.ird.gov.bd/। এই সাইটে প্রাইজবন্ডের নাম্বার এবং সিরিজ লিখে আপনি সহজেই চেক করতে পারবেন যে আপনি প্রাইজবন্ড লটারী জিতেছেন কি না।
সর্বসাকূল্যে, প্রাইজবন্ড কি, কোথা থেকে কিনবেন, কেন কিনবেন এবং এর সুবিধা-অসুবিধাগুলো সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হলো। বিনিয়োগের পাশাপাশি ভাগ্য পরীক্ষার এক আকর্ষণীয় সুযোগ এই প্রাইজবন্ড। এটি সহজে কেনা যায়, যেকোনো সময় ভাঙানো যায় এবং বছরে চারবার এ থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির সুযোগ থাকে। তবে এর ড্রতে জেতার অনিশ্চয়তা, স্বল্প লভ্যাংশ বা কর কর্তনের বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখা উচিত। সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা দুটোর প্রতিই গুরুত্বারোপ সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করবে।