ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের ক্যানসার জয়ের গল্প
ক্যাম্পাসে ছাত্রী ও সহকর্মীদের কাছে শান্ত, উদ্যমী ও ধৈর্যশীল একজন নারী হিসেবে পরিচিত ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য। মাতৃত্বের কোমলতা আর মানসিক জোর নিয়ে বেঁচে থাকার প্রাণশক্তিতে ভরা একজন শিক্ষক। প্রমাণ মেলে ২০১৫ সালে, যখন ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আপনজনেরা চরম দুশ্চিন্তায় পড়লেও নিজের শক্ত মনোবলে ভর করে এই প্রাণঘাতী ব্যাধি জয় করেন সুপ্রিয়া। কীভাবে কঠিন পরিস্থিতিকে হাসিমুখে জয় করতে হয়, তা তিনি দেখিয়ে দেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে লিখতে চাই জানালে স্বভাবসুলভ বললেন, ‘আমাকে নিয়ে লেখার কী আছে?’
অধ্যাপক সুপ্রিয়া বলছিলেন, ‘ক্যানসার যতটা না শারীরিক যন্ত্রণা দেয়, তার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়। ক্যানসার ধরা পড়ার পর আমার পরিবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো যে, আমি আর কতক্ষণ এই পৃথিবীতে আছি। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন আমার কারণে অন্যেরা কষ্ট পায়। তাই বাসায় আমার প্রিয়জনকে নিমন্ত্রণ করতাম না, একটাই কারণ—তারা আমার অবস্থা দেখে কষ্ট পায়, মন খারাপ করে।’
‘২০১৪ সালের শেষদিকে আমার জরায়ুতে অস্ত্রোপচারের পর ক্যানসার ধরা পড়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম, চিকিৎসকের নিয়ম অনুযায়ী চলব, আর পরিমিত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলব, তাতেই হয়তো মুক্তি পাব। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ২০১৫ সালে একদিন হঠাৎ ক্লাস নেওয়ার আগে শরীর খারাপ লাগায় সহকর্মীকে (প্রয়াত শ্রদ্ধেয় সাইফুল ইসলাম) ক্লাস নিতে বলে আমি হাসপাতালে গেলাম। চিকিৎসক আমার অবস্থা দেখে একটা আলট্রাসাউন্ড করাতে নিয়ে গেলেন। রিপোর্ট দেখে আমাকে ভর্তি করালেন। আমি বললাম বাসায় গিয়ে পরের দিন আসব। মানলেন না, ভর্তি হতেই হবে। আমাকে এক্স-রে করাতে দিলেন। তখনই রিপোর্টে ধরা পড়ল—আমার ফুসফুসে ক্যানসার আক্রমণ করেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি দেশে চিকিৎসা করাব, নাকি বিদেশে। আমি আমার পরিবারের কথা মতো সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে যাই।
‘বিমানবন্দরে আমার সহকর্মীরা আমাকে বিদায় দিতে আসে। আসলে সেই সময়টাতে তাঁরা ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু, মনকে সাহস দিচ্ছিলাম— আমাকে চিকিৎসাটা শুরু করার জন্য যেভাবেই হোক সিঙ্গাপুরে পৌঁছাতে হবে। ক্যানসারের কোনো ব্যাথা নেই, শুধু জ্বর আর দুর্বলতা। ফ্লাইট থেকে নামার পরে আমি বুঝলাম কতটা অসুস্থ আমি। আমার এক কদম পা ফেলতে পাঁচ মিনিটের মতো লেগেছিল। ২৯ দিন ছিলাম। একটা কেমোথেরাপি নিয়ে আমি বাংলাদেশে চলে আসি। আমার মানসিক শক্তি দেখে ওখানকার চিকিৎসকরাও চমকে গিয়েছিলেন। ঢাকায় দুই বছরে ছয় সাইকেলে মোট ১২টা কেমো শেষ করি। নিঃশ্বাসে সমস্যার কারণে প্রথম ছয় মাস ছুটিতে ছিলাম।’
ক্লাসে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে পড়াতে ভালবাসেন। প্রাঞ্জল কথামালার কারণে তাঁর ক্লাসে অমনোযোগী হওয়ার সুযোগ থাকে না। আমার বিভাগের হওয়ায় তিন বছর তাঁর ক্লাস পেয়েছি। ক্লাসগুলোতে মন্ত্রমুগ্ধ থাকতাম বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। মনে মনে সুপ্রিয়া ম্যামের মতো হতে চাই, এমন ভেবেছি সব সময়। লেখার সুযোগে জানতে চেয়েছিলাম, এতটা প্রাণবন্ত ক্লাস নেন কী করে। জবাবে বললেন, ‘কারণ একটাই, তা হচ্ছে আমি সবসময় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে পাঠক্রমগুলো বোঝানোর চেষ্টা করতাম।’
এ ছাড়া ম্যাম সব সময় যে কথাগুলো আমাদের বলতেন, তা হলো—‘আমি বিশ্বাস করি, ভালো কিছু পেতে হলে ধৈর্য আর কথায়-কাজে সততা ও আন্তরিকতা থাকতে হবে। আমি শুধুই আমার, এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে আশপাশের সবার কথা ভাবতে হবে, সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত করতে হবে। আমি অন্যকে কষ্ট দিয়ে চাই না, এটাই আমার বড় মানসিক জোর। বেঁচে থাকতে হলে সব সময় হাসি মুখে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
১৯৮০ সালে এসএসসি ১৯৮২ সালে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে ১০ম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে সরকারি কর্ম কমিশনের শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে চট্টগ্রামের পটিয়া সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য। তারপর যান হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে, পরে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে, তারপর চট্টগ্রাম সিটি কলেজে, আবার চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে এবং সর্বশেষ ইডেন মহিলা কলেজে। বর্তমানে এখানে অধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন।
আলাপের শেষ বেলায় অধ্যাপক সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি মনে করি আমার ছাত্রীদের দোয়ার কারণে আমি আবার নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি।’