কর্ম জীবনে উন্নতির জন্য কিভাবে প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরি করবেন

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কিং একটি গুরুত্বপূর্ণ সফট স্কিল। একজনের কথা আরেকজন কত সহজভাবে বুঝতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক। আর এই সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে পরিচালিত হয় তাদের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ। পরস্পরকে অনুধাবনের এই ব্যাপারটি যখন দু’জন থেকে অনেক মানুষে ছড়িয়ে পড়ে তখন এর প্রভাবও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই দক্ষতা অর্জন বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এটি প্রতিনিয়ত অনুশীলনের দাবি রাখে। তাই চলুন জেনে নেয়া যাক, শিক্ষাজীবন থেকেই কিভাবে প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায়।
শিক্ষাজীবনেই প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরির দিক-নির্দেশনা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যারিয়ার অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখা
ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিভিশন অথবা অ্যাডমিনের অধীনেই আভ্যন্তরীণ স্টুডেন্ট গ্রুপ সহ ক্যারিয়ার সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যকলাপের খোঁজ মেলে। ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই এই খোঁজের কাজটি করে নেয়া যায়। পাশাপাশি অনুষদের কর্মকর্তা এবং এর সাথে সংযুক্ত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথেও গড়ে তোলা যায় সুসম্পর্ক।
এই স্টুডেন্ট গ্রুপ এবং একাডেমিক বিভাগ অধ্যয়নরত এবং সদ্য স্নাতক পাশ করা শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এই ক্যারিয়ার সেন্টারের লক্ষ্যই থাকে একজন শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার উন্নত করতে সঠিক লোকদের সাথে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করা। এই সেন্টার নতুন শিক্ষার্থীদের সঠিক ক্যারিয়ার নির্বাচন থেকে শুরু করে ইন্টারভিউয়ের পূর্বপ্রস্তুতির জন্য একজন পরামর্শদাতা নিয়োগ করে দেয়।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেয়া
স্কুল ও কলেজ শেষ করার পর সেখানকার প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের গ্রুপটিকেও সমান গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। পুরনো ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে আয়োজিত পুনর্মিলনীগুলো এক্ষেত্রে যেমন তাৎপর্যবহুল তেমনি বেশ আবেগেরও ব্যাপার। পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার অনুভূতি সত্যিই অতুলনীয়।
আর ইউনিভার্সিটিতে প্রথম বর্ষ থেকেই সংযুক্ত হওয়া যায় অ্যালামনাই গ্রুপের বিভিন্ন কার্যকলাপের সঙ্গে। এর মাধ্যমে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিতে সফল তাদের কাছ থেকে কর্মজীবনের নানা দিক সম্পর্কে ব্যবহারিক জ্ঞান লাভ করা যায়। এমনকি তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিমেষেই পৌঁছে দিতে পারে কাঙ্ক্ষিত নিয়োগকর্তার কাছে। তাই তাদের ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে তাদের সামাজিক মাধ্যম, ইউনিভার্সিটির নোটিশ বোর্ড এবং বিভিন্ন ইভেন্টে যোগদান করতে হবে।
লিংকডইন এবং অন্যান্য সামাজিক মিডিয়াগুলো ব্যবহার করা
গত এক দশক জুড়ে করপোরেট জগতে লিঙ্ক্ডইড সামাজিক মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন এই মাধ্যমটি শুধু পেশাজীবী লোকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাও এতে যোগ দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকা বিশ্বে এখন শিক্ষাজীবন থেকে কর্মমুখী হওয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউনিভার্সিটির প্রথম বছর থেকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্জনগুলো দিয়ে সামাজিক প্রোফাইলটি ভরতে হবে। এভাবে স্নাতক পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে পোর্টফোলিওটা। লিংকডইন ফিচারের মাধ্যমে সদ্য পাশ করা স্নাতক ডিগ্রীধারীর অর্জনগুলো দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ফলে তারা নিমেষেই নিয়োগকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
পেশাজীবীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার সুবাদে প্রতি মাসে দুই লাখেরও বেশি কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী লিংকডইন-এ যোগদান করছে। ইতিমধ্যেই লিঙ্কডইনে তিন কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী প্রোফাইল রয়েছে। নিদেনপক্ষে, কলেজ-ই হচ্ছে লিংকডইন প্রোফাইল করার সেরা সময়।
শিক্ষকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা
কলেজ ও ইউনিভার্সিটির লেকচারারদের মধ্যে এমন অনেকেই থাকেন যারা খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের মন জয় করে ফেলেন। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে তারা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। এমন একজন শিক্ষক-ই যথেষ্ট শত শত শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার গড়ে দেবার জন্য। তাই তাদের জীবনমুখী পরামর্শ পেতে শিক্ষার্থীদেরও তাদের সঙ্গে ঘন ঘন কথা বলা উচিত।
শিক্ষকরা তাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সম দক্ষতার লোকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট ক্যারিয়ার তৈরির পথটি সুগম হয়। এমনকি যারা কি নিয়ে পড়বে বা কর্মজীবন নিয়ে বিড়ম্বনায় থাকে তাদেরকেও তাদের পছন্দ-অপছন্দ যাচাই করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন এই শিক্ষকরা। তাই শুধু অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া-নেয়ার মধ্যে না থেকে ছাত্র-শিক্ষক-এর সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়তার সম্পর্কে আরও যত্নবান হওয়া
স্কুলের বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশি, এলাকার বন্ধু-বান্ধব, পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন এমনকি পরিবারের সদস্যরাও এই গন্ডির অন্তর্ভূক্ত। অনেকের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমটি সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। এখানে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে- একজন শিক্ষার্থী তার ঘনিষ্ঠজনদেরকে নিজের ক্যারিয়ার পরিকল্পনার ব্যাপারে খুব সহজেই জানাতে পারে।
সরাসরি সাহায্য করতে না পারলেও তারা নিজেদের পরিচিতদের মধ্য থেকে এমন কাউকে খুঁজে দেয় যে প্রকৃতপক্ষে সাহায্য করতে পারবে। এমনকি প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় খুব ভালো একটি চাকরির ব্যবস্থাও হয়ে যায়।
ভলান্টিয়ার বা ইন্টার্নশিপ বা পার্ট টাইম জব করা
কর্মক্ষেত্রের ওপর সরাসরি ব্যবহারিক জ্ঞান পেতে এই কার্যকলাপগুলোর কোন বিকল্প নেই। একটি নির্দিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিতে শুধু হাতে-কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতাই নয়; এর মাধ্যমে সখ্যতা হয় একই ক্যারিয়ার নিয়ে কাজ করা লোকদের সঙ্গে। তাছাড়া ফুল টাইম চাকরি বাজার খুব কঠিন হলেও এই সুযোগগুলো অহরহই মেলে। এ সময় কাজের ধরনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে অভিজ্ঞতা ও সফট স্কিল অর্জনকে।
প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, এরকম মাধ্যমগুলোতে কর্মরত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। কর্মজীবনের এই ক্ষেত্রগুলো একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং পোর্টফোলিও তৈরির সর্বোৎকৃষ্ট উপায়।
করপোরেট বা সামাজিক নেটওয়ার্কিং ইভেন্টগুলোতে অংশগ্রহণ করা
ক্যারিয়ার বা জব ফেস্ট এবং বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মত করপোরেট ইভেন্টগুলো সারা বছরই হতে থাকে। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন বা সংস্কারমূলক কাজে মহল্লার লোকদের একত্রিত হতে দেখা যায়। এই ইভেন্টগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণ নেটওয়ার্ক বৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা রাখে।
করপোরেট ইভেন্টগুলোর জন্য প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো কোম্পানির নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া পেজ। টিভি ছাড়াও এরা অধিকাংশ সময় ইউটিউব, ফেসবুকে তাদের ইভেন্টের প্রোমোশন করে। ফেসবুকে অনেক গ্রুপ আছে যেগুলোতে এমন ইভেন্টের খোঁজ পাওয়া যায়। সামাজিক ইভেন্টগুলোর ক্ষেত্রেও একই উপায় অনুসরণ করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে কোন সামাজিক মিলনমেলা এড়ানো উচিত নয়। এগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে উদ্দেশ্য হাসিল না হলেও গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় থাকে। যার সূত্র ধরে পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য পাওয়া যায়।
নেটওয়ার্কের সদস্যদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া
এই কাজটিকে একটি বড় বিনিয়োগ হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে। পরস্পরের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে একটি নতুন সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতার দিকে এগিয়ে যায়। আর কর্মক্ষেত্রের জন্য একটি সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। এই সহযোগিতাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে নেটওয়ার্কের যত্ন নেয়। পাশাপাশি এটি নিজের মার্কেটিং-এরও একটি বড় উপায়।
এর মাধ্যমে নেটওয়ার্কের লোকদের কাছে খুব সহজেই স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি হওয়ার দরুণ নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে চরম বিপদের মুহুর্তে সাহায্যের প্রতিদান পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এভাবেই আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে নেটওয়ার্কটি।
অনুসরণীয় ব্যক্তিবর্গের মেন্টরশীপ নেয়া
নির্দিষ্ট কোন ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের একটি জায়গা করে নিতে সেখানে সফল কোন ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে অনুসরণ করা যেতে পারে। আর এই অনুসরণীয় ব্যক্তিকে ক্যারিয়ার মেন্টর হিসেবে পেলে সেই প্রচেষ্টার পথটি আরও সাবলীল হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো তাদের কাছে পৌঁছানো। প্রচন্ড ব্যস্ততার দরুণ তারা সাধারণত সবার সঙ্গে সময় দিতে পারেন না।
এ ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের নিজেদেরকে পরিবেশনের জন্য অধিক সৃজনশীল ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। সেই অনুসরণীয় ব্যক্তিটিকে নিয়ে গবেষণা করতে হবে। তাদের ভালো লাগা মন্দ লাগার ব্যাপারে জানতে হবে। এমনকি তারা প্রতিদিন কি করছেন, সে ব্যাপারেও অবহিত থাকতে হবে। , ফেসবুক প্রোফাইল অনুসরণ করা যেতে পারে। পরিচয়ের শুরুতে সঠিক শব্দ বাছাই করে উপযুক্ত একটি বার্তা প্রেরণের সময় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে।
অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা
কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বাইরেও বাড়িয়ে দিতে হবে বন্ধুত্বের হাত। এটি কর্মক্ষেত্রে সফলতার সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এর জন্য দুই বা ততোধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে সংঘটিত ইভেন্টগুলোতে অংশ নিতে হবে। স্বভাবতই এখানে প্রয়োজন হবে ঘন ঘন পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যকলাপের।
এই প্রবণতাটি বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং বিরাট নেটওয়ার্ক তৈরিতে অনেক কার্যকরি ভূমিকা রাখে। অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্কেলগুলোতে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় সেখানকার ক্যারিয়ার সেন্টার ও স্টুডেন্ট ক্লাবগুলোতে। এমনকি সেখানকার শিক্ষকদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এই প্রফেশনাল নেটওয়ার্ক তৈরি এবং তা অটুট রাখার মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার নৈপুণ্য একটি আবশ্যক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাজীবন থেকে প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং তৈরি অনুশীলন শুরু করলে কর্মজীবনে প্রবেশের আগেই নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া যাবে। শুধু তাই নয়; অনুশীলনের সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন কাজে এর সুফল পাওয়া যাবে। ঘন ঘন পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমগুলোতে অংশ নেয়ার মাধ্যমে উন্নত করা যাবে নিজের পোর্টফোলিওকে। যা সদ্য স্নাতক পাশ করার পরে কাজের অভিজ্ঞতাহীন অবস্থার বাধাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।