জাকসু নির্বাচন ঘিরে সরগরম জাবি ক্যাম্পাস

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। ইতোমধ্যে তফসিল ঘোষণা শেষে মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও জমাগ্রহণও শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ১১ সেপ্টেম্বর একযোগে ২১টি হলে অনুষ্ঠিত হবে জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের।
ক্যাম্পাসের আবাসিক হল, বিভাগগুলো থেকে শুরু করে বটতলা, ক্যাফেটেরিয়া, চৌরঙ্গী পয়েন্টসহ সব আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু এখন জাকসু নির্বাচন। এতে নির্বাচনকে ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা আসন্ন জাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের সার্বিক অধিকার আদায়ে কাজ করবেন।
মনোনয়ন জমা দেন ৭৪০ শিক্ষার্থী
জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য ১৯-২১ আগস্ট পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম জমা দেন মোট ৭৪০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে জাকসুর ২৫টি পদের বিপরীতে মনোনয়ন দিয়েছেন ২৭৩ জন শিক্ষার্থী এবং হল সংসদের জন্য মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন ৪৬৭ জন শিক্ষার্থী। এগুলো যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৫ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে কমিশন।
শিবির-বাগছাসের প্যানেল ঘোষণা, আন্তকোন্দলে বাধা ছাত্রদলের প্যানেল
জাকসুকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই প্যানেল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)। অন্যান্য দল ও সংগঠনগুলোও প্যানেল তৈরীর কাজ শুরু করেছে। তবে দলীয় আন্তকোন্দলে আটকে রয়েছে ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণা।
ক্যাম্পাসের বটতলা, টারজান পয়েন্ট, ক্যাফেটেরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় দেখা মিলছে আলোচনায় মগ্ন ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতাদের। প্যানলের পাশাপাশি মতাদর্শের ভিত্তিতে জোট গঠন করার বিষয়েও আলোচনা করছে কেউ কেউ।
তবে জাকসুকে ঘিরে শাখা ছাত্রদলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি দেখা গেছে। গত ৮ আগস্ট ১৭টি আবাসিক হল ও শাখা কমিটি বর্ধিত করার পর নবগঠিত কমিটিতে বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদ দেওয়ার অভিযোগে একাংশ বিক্ষোভ করেন। এরপর থেকে ওই অংশের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে নিয়মিত শোডাউন করছেন। তবে এর প্রভাব জাকসুতে পড়বে না বলে জানিয়েছে শাখা ছাত্রদলের দুই গ্রুপের নেতারা।
জাকসু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, জাকসুতে ছাত্রদলের আলাদা প্যানেল থাকবে। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়েই গত ছয় মাস কাজ করছি। দলের সবার সঙ্গে আলোচনা করছি। তফসিল অনুযায়ী ২৫ তারিখে খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর জাকসু ও হল সংসদের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করব। প্যানেল ঘোষণা নিয়ে তিনি আরও বলেন, প্যানেল ঘোষণার ক্ষেত্রে যারা শিক্ষার্থীদের কাছে বেশি জনপ্রিয় এবং যাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি তাদের আমরা ছাত্রদলের প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত করব।
ছাত্রদলের বিদ্রোহী বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের বিষয়ে আহ্বায়ক বলেন, যারা ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নামে হট্টগোল করছেন, তাদের সবারই পদ আছে। দলীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই কমিটি দেওয়া হয়েছে। তবে এ সমস্যা আমরা প্রায় সমাধান করে ফেলেছি। খুব দ্রুতই আমরা প্যানেল ঘোষণা করব।
প্রগতিশীল (বামপন্থী) শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্তত দুটি প্যানেল হওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। একটি প্যানেলে থাকতে পারে ছাত্র ইউনিয়ন একাংশ (অদ্রি-অর্ক), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (ফাইজা), ছাত্র ফ্রন্ট (মার্কসবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ কয়েকটি সমমনা সাংস্কৃতিক সংগঠন। অন্য প্যানেলে থাকছে ছাত্র ইউনিয়নের অপর অংশ (জাহিদ-তানজিম), জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট (মেঘ), জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, গণ-অভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন।
এ ছাড়া জাকসুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মতাদর্শের বেশকিছু প্রার্থীরা প্যানেলের বাইরে গিয়ে “স্বতন্ত্র” নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, “আমরা প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করছি। নির্বাচনের সামগ্রিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য সবার মতামত নিচ্ছি। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা প্রয়োজন তা করতে প্রস্তুত রয়েছি।
তবে শিক্ষার্থীরা দল দেখে নয়, প্রার্থী দেখেই ভোট দিবেন বলে জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো দলীয় মতাদর্শ নয়, তাদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা কেমন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবেন কি-না, এসব দেখে ভোট দেবেন তারা।
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, সংগঠন দেখে ভোট দেওয়াটা বিবেচনায় নেই। আমরা দেখব প্রার্থী মানুষ হিসেবে কেমন, কে কাজ করেছে, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দেবো। যে আমাদের জন্য কাজ করবে, আমাদের অধিকার আদায়ে আগামীতে কাজ করতে আগ্রহী তাকেই সব শিক্ষার্থীরা নির্বাচিত করবে বলে আমি আশাবাদী।”
জার্নালিজম ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রুবেল হোসেন বলেন, “জাকসুতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার বিবেচনায় থাকবে প্রার্থীর কাজ করার স্পৃহা, তার ইতোপূর্বের অভিজ্ঞতা এবং দলমত নির্বিশেষে সব সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য তার ভাবনা, কী কী কাজ তিনি করতে চান। শিক্ষার্থীদের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যে ঘটাতে পারবে সেই নির্বাচিত হবে বলে আমরা মনে করছি।
মোট ভোটার ১১,৯১৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। গত রোববার রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে এ তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
এর আগে, গত ১০ আগস্ট রাতে খসড়া ভোটার তালিকা ও খসড়া আচরণবিধি প্রকাশ করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ও চূড়ান্ত আচরণবিধি প্রকাশ করেছে কমিশন। চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী ২১টি আবাসিক হলে মোট ভোটার ১১ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ৬ হাজার ১০২, আর ছাত্রী ভোটার ৫ হাজার ৮১৭ জন। এর মধ্যে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর মধ্যে আলবেরুনী হলে ২১১, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে ৩৪১, শহিদ সালাম-বরকত হলে ২৯৯, মওলানা ভাসানী হলে ৫২১, ১০ নম্বর হলে ৫৪০, শহিদ রফিক-জব্বার হলে ৬৫৬, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে ৩৫৭, ২১ নম্বর হলে ৭৫২, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে ৯৯৪, শহিদ তাজউদ্দীন আহমেদ হলে ৯৫৪ ও মীর মশাররফ হোসেন হলে ৪৭৭ জন।
ছাত্রী হলগুলোর মধ্যে নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলে ২৮২, জাহানারা ইমাম হলে ৪০০, প্রীতিলতা হলে ৪০২, বেগম খালেদা জিয়া হলে ৪১৭, সুফিয়া কামাল হলে ৪৬০, ১৩ নম্বর হলে ৫৩২, ১৫ নম্বর হলে ৫৭৬, রোকেয়া হলে ৯৫৭, ফজিলাতুন্নেছা হলে ৮০৮ ও বীর প্রতীক তারামন বিবি হলে ৯৮৩ জন।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের ক্যাম্পাসে এখন উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে আমরা সতর্ক রয়েছি। নির্বাচনে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এজন্য সব অংশীজনের সহযোগিতা কামনা করছি।’
প্রসঙ্গত, গত ১০ আগস্ট জাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্য সচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলম তফসিল ঘোষণা করেন। তফসিল অনুযায়ী, চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ২৯ আগস্ট এবং ভোটগ্রহণ ১১ সেপ্টেম্বর।