মুদাসসির খান : দিল্লির দগদগে ক্ষতে লেখা এক নাম

ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রাণ হারানোদের মধ্যে একজনের নাম মুদাসসির খান। সিএএ নিয়ে উত্তাল ভারতের রাজধানী দিল্লির সহিংসতায় বাড়ছে লাশের সংখ্যা। চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
মুদাসসির খানের পরিবার গত মঙ্গলবার থেকেই দিল্লির জিটিবি হাসপাতালের মর্গের বাইরে অবস্থান করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবারও সকাল থেকেই হাসপাতালে ছিলেন তাঁরা। মুদাসসিরের ভাগ্নে আরবাজ খান গতকাল জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলেছে, ফাইল প্রস্তুত, ময়নাতদন্ত হলেই লাশ বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন।

মুদাসসিরের পরিবার জানিয়েছে, সোমবার কারদামপুরিতে বাড়ির বাইরে বের হওয়ার পরই দুর্বৃত্তরা মুদাসসিরকে আক্রমণ করে। তাঁর মাথায় গুলি করা হয়। পরে জিটিভি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মুদাসসিরের ভাগ্নে আরবাজ আরো বলেন, ‘কেউই শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। এখনো ভয় কাজ করছে। শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না, সবাই বাড়ির ভেতরেই থাকছে। এমনকি আমরা নিজেদের যানবাহনে করেও বের হতে পারছি না। তিন দিন ধরে যা হচ্ছে, আমরা সবাই আতঙ্কিত।’

মুদাসসিরের মতো প্রতিদিনই বিভিন্ন পরিবার জিটিবি হাসপাতালের বাইরে তাঁদের প্রিয়জনের লাশ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ ছাড়া দিল্লিতে সহিংসতায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন অনেকের পরিবার ও বন্ধুরা।
অনেকে অভিযোগ করছেন, পুলিশ অথবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউই জানাচ্ছে না কখন ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হবে। আর সে জন্য লাশও নিয়ে যেতে পারছেন না অনেকের পরিবার। সংবাদমাধ্যম পুনে মিররের এক প্রতিবেদনে দিল্লির সহংসতায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে।

শাহবাজ (২২) গত মঙ্গলবার থেকে নিখোঁজ, তাঁর মাসহ স্বজনরা জিটিবি হাসপাতালের মর্গের বাইরে অবস্থান করে আছেন। মা জানেন না, আদৌ তাঁর সন্তান বেঁচে আছেন কি না।
শাহবাজের মা বলেন, ‘চোখের সমস্যা নিয়ে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে কারাওয়াল নগরে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল শাহবাজ। বিকেল ৩টার দিকে ফোন করে সেটি বন্ধ পাই।’ শাহবাজ তাঁর পরিবারসহ লনি এলাকায় থাকেন। তিনি ওয়েল্ডিংয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দুদিন থেকে হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন মুশাররফের (৩৫) পরিবার। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে কী ঘটেছিল, সবাইকে আমি জানাচ্ছি, কিন্তু কেউ আমাকে জানাচ্ছে না, কখন ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হবে।’
ভয়াবহ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে মুশাররফের স্ত্রী বলেন, ‘একদল লোক আমাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে আমার স্বামীকে নির্মমভাবে মারধর করে। বাড়ি থেকে বের করে তাঁকে আবারও মারতে থাকে।’
এরই মধ্যে ভারতের নয়াদিল্লিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে সহিংসতায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ জনে। এ ছাড়া আহতদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে দিল্লির গুরু তেজবাহাদুর হাসপাতালে। এদিকে, এ সহিংসতার ঘটনায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে দিল্লি পুলিশ। পুলিশকে তদন্ত করে দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ১৮ এ খবর জানিয়েছে।

এদিকে, গত বুধবার সহিংসতাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। গতকাল বৃহস্পতিবার দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। আর সেখানে তিনি প্রথমে বেশ কয়েক স্তরে ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেন। তিনি জানান, নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। যাঁরা স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের পাঁচ লাখ রুপি করে দেওয়া হবে। যাঁরা গুরুতর আহত হয়েছেন, তাঁদের দেওয়া হবে দুই লাখ রুপি করে। যাঁরা সামান্য আহত হয়েছেন, তাঁদের ২০ হাজার রুপি করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া সহিংসতায় যাঁদের বাড়ি একেবারে পুড়ে গেছে, তাঁদের পাঁচ লাখ রুপি করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন কেজরিওয়াল। যাঁদের দোকান লুট করা হয়েছে, তাঁদের ২৫ হাজার রুপি করে দেওয়ার কথাও ঘোষণা দেন তিনি।

এদিকে, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ গোটা দেশে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে অনেক এলাকা। সারি সারি পোড়া গাড়ি, বাড়ি ও সড়কপথের অবস্থাও ভালো নয়। গুলি, লাঠিচার্জ, পাথর-বৃষ্টি ছাড়াও বুধবার ফিল্মি কায়দায় এসিড হামলার ঘটনাও ঘটে। মেট্রো স্টেশনগুলো নীরব হয়ে আছে। জনমানবশূন্য অবস্থা দিল্লির বেশির ভাগ এলাকা। এতে আহত হন পুলিশ সদস্যও। হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি অনেকেই, যে কারণে বেড়ে চলছে নিহতের সংখ্যাও।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি বলছে, দাঙ্গায় উসকানির জন্য বিজেপির কপিল মিশ্রের পর আলোচনায় এসেছে আম আদমি পার্টির কাউন্সিলর তাহির হুসাইনের নাম। এদিকে, দাঙ্গায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাহির হুসাইনকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, দাঙ্গায় জড়িত সন্দেহে চার শতাধিক মানুষকে আটক করা হয়েছে।

অন্যদিকে, গুজরাট বা শিখ দাঙ্গার স্মৃতি ফেরাচ্ছে দিল্লির সংঘর্ষ—এমন মন্তব্যের জেরে বদলি করে দেওয়া হয় দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি জাস্টিস এস মুরলিধরকে। দিল্লিতে সহিংসতার জন্য তিনি সমালোচনা করেছিলেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের। তাই চড়া মূল্য গুনতে হয় তাঁকে। দিল্লির হাইকোর্ট থেকে বুধবার রাতেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বিচারপতি এস মুরলিধরের বদলির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন দিল্লিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে বিচারপতি মুরলিধরকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা কোর্টে নিযুক্ত করা হয়।