সাকা, মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরে বাকি দুই ধাপ
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় আজ বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু রায় কার্যকর করতে আরো দুটি আইনি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। এ দুটি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর রায় কার্যকর করতে আর বাধা থাকবে না বলে মনে করেন আইনবিদরা।
প্রথমত, আজ প্রকাশিত আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে পড়ে শুনানোর পর তাঁরা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করার সুযোগ পাবেন। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাঁরা রায় হাতে পাওয়ার পর ১৫ দিন সময় পাবেন।
এর পর রিভিউ আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানি হবে। শুনানি শেষে তাঁদের আবেদন খারিজ হলে এ বিষয়ে রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পরই আসামির আদালতের সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হবে।
বাকি থাকবে শেষ প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে সব দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ এ দুই নেতা।
কারাবিধি অনুযায়ী, একজন অভিযুক্তের রায় রিভিউ বা পুনর্বিবেচনার রায় হওয়ার পর থেকে তিনি প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য সাতদিন সময় পেয়ে থাকেন। এরপর তাঁকে ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৭ দিনের বেশি নয়- এমন সময়ের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। তবে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় নিয়ে আসামিপক্ষ এবং রাষ্ট্রপক্ষের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
জামায়াত নেতা মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লারফাঁসির কার্যকরের সময় এই বিধি মানা হয়নি। এর কারণ হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্ষেত্রে কারাবিধি প্রযোজ্য হবে না।’
রাষ্ট্রের প্রধান এ কর্মকর্তা আরো বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে প্রাণভিক্ষা চাওয়া নিয়ে কোনো সময়সীমা নেই। যে কারণে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হওয়ার পর প্রাণভিক্ষা বাতিল হলে সরকার চাইলে যেকোনো দিন ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।
অপরদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সময় সাতদিন দিতে হয়। এরপর আসামি প্রাণভিক্ষা না চাইলে অথবা প্রাণভিক্ষা আবেদন বাতিল হলে কারাবিধি অনুযায়ী একজন আসামিকে ২১ দিনের আগে নয় এবং ২৭ দিনের পরে নয় এমন সময়ে ফাঁসি কার্যকর করতে হয়।’
গত ১৬ জুন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আপিলের এই বেঞ্চই মানবতাবিরোধী অপরাধে গত ২৯ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। আজ বুধবার ১৯১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়।
গত বছর ৩ নভেম্বর আপিলের চূড়ান্ত রায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে দেওয়া ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই দিন সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায়।
এরপর ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানরে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে আসামির আইনজীবীরা ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন করেন। এতে করে পরোয়ানার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। সে সময় সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির প্রাক্কালে কামারুজ্জামানের পক্ষে করা সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১ এপ্রিল শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। শুনানি শেষে ৬ এপ্রিল তাঁর পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় ১১ এপ্রিল রাতে কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল। কাদের মোল্লার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ওই দিন ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ছয়টির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল২-এর ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা বাড়িয়ে চূড়ান্ত এ রায় প্রদান করেন সর্বোচ্চ আদালত। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় এবং ১২ ডিসেম্বর রাতে কার্যকর হয় কাদের মোল্লার ফাঁসি।
এ সময় কাদের মোল্লা চূড়ান্ত রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে পারবেন কি না এ বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয় আসামি এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে। এ কারণে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সময় ১০ ডিসেম্বর রাতে নির্ধারিত হলেও মাত্র দুই ঘণ্টা আগে তাঁর আইনজীবীরা দুটি আবেদন করেন।
একটিতে ওই রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয় এবং দ্বিতীয় আবেদনে রায় পুনর্বিবেচনা করে কাদের মোল্লার খালাসের আবেদন করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত এসব আবেদন খারিজ করে দিলে কার্যকর করা হয় ফাঁসির দণ্ড।
কিন্তু রিভিউ গ্রহণ ও খালাসের আবেদন একত্রে খারিজ হওয়ায় এ ধরনের মামলায় রিভিউ আদৌ চলবে কি না, সে অস্পষ্টতা থেকে যায়। রিভিউয়ের এ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত বছরের ২৫ নভেম্বর। এতে যুদ্ধাপরাধের মামলাতেও সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা যাবে বলে রায় প্রদান করেন আপিল বিভাগ। ফলে কামারুজ্জামানসহ অন্য সাজাপ্রাপ্তরাও তাঁদের দণ্ডাদেশের রিভিউয়ের আবেদন করার সুযোগ পাচ্ছেন। একইসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও একই আবেদন করতে পারবেন।