আনিসুজ্জামানের আলোকিত ভুবন

‘ধর্ম নিয়ে যে-সম্প্রীতির বোধ আমাদের মধ্যে ১৯৭০-৭১ সালে ছিল, এখন সেটা অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন আর কেউ দাঙ্গা হচ্ছে শুনে বাড়ি থেকে দৌড়ে আক্রান্তের পাশে ছুটে যায় না। অনেক আপত্তিকর ওয়াজ, নসিহত বা ফতোয়া মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। নেতাদের অনেকে বলেন, ধর্মের কথা না বললে সমর্থন চলে যাবে। ১৯৭০ সালে এটা মনে করার কোনো কারণ ছিল না। এমনকি ১৯৫০ সালেও না। ১৯৪৮-৪৯ সালে মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের কথা বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী বলেছেন, ১৯৫৪-৫৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন। এঁরা পাকিস্তানের তুঙ্গ মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে দেখতে পেয়েছিলেন।’
ওই কথাগুলো সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের। মৃত্যুর বেশ আগে একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকারে এমনটা বলেছিলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ড. আনিসুজ্জামান। করোনাকালে বার্ধক্যজনিত রোগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর পর জানা গেল তিনি করোনা পজিটিভ ছিলেন। শুক্রবার সকালে আজিমপুর কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। বাংলাদেশের সাহিত্য ভুবনে তাঁর দৃপ্ত পদচারণা ছিল, তিনি বড় সাহিত্যিকদের শিক্ষক ছিলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমি তাঁকে যেটুকু দেখেছি, এই সাহিত্যজগতের বাইরে তিনি সব সময় সক্রিয় থেকেছেন উদার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে। তিনি সব রাজনীতি দেখেছেন এই মাটিতে—ডান, বাম, মাঝামাঝি এবং প্রতিটি পরিবর্তনের বাস্তবতাকে তিনি দেখেছেন তাঁর মতো করে।
তীব্র, সংঘর্ষঘন, দ্রুত ধাবমান ইতিহাসের সঙ্গে ছিলেন তিনি সব সময়। স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসকচক্র রবীন্দ্রনাথের গান বেতার ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে যেমন অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধেও ছিলেন তেমনিভাবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আনিসুজ্জামান ছিলেন কলকাতায়। সেখানে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের সদস্য। আর স্বাধীন দেশে তিনি কাজ করেছেন বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা কমিশনে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি।
বুদ্ধিজীবী হয়েও রাজপথে-জনপদে, মানুষের মিছিলে তিনি ছিলেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান সংযোজনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা রুজু করেছেন, ১৯৯২ সালে গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উত্থাপনকারী হিসেবে সামনে দাঁড়িয়েছেন। আর এ জন্য সে সময়ের বিএনপি সরকার তাঁর এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছিল।
অর্থাৎ তিনি একজন সাদামাটা সাহিত্যিক শুধু ছিলেন না। প্রবীণ বা সাহিত্যের বড় অধ্যাপক মাত্রই কেবল সভা-সমিতির উপদেষ্টা, বক্তৃতা করবেন শুভচিন্তকের মতো, এমন দপ্তরি বুদ্ধিজীবী ছিলেন না অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি বিপ্লবী ছিলেন না, কিন্তু তিনি ভাবতেন হিংসাত্মক গণতন্ত্র এবং শাসনপ্রথা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাঙালির করণীয় কী, তা নিয়ে। তাঁর সঙ্গে আমার যেটুকু আলাপ হয়েছে এ জীবনে, সাহিত্য নিয়ে আমি এক অক্ষরও তাঁর কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা ছিল না। আমি তাঁর কাছ থেকে বাংলাদেশ-পূর্ব, এবং ১৯৭৫-পূর্ব ও পরের রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে জানতে চাইতাম। আমরা কী করে চালিত, শাসিত হতাম, আর আজ কী করে হব, তার কথাকাহিনি শুনতে চাইতাম।
আমার মনে হয়েছে, রাজনীতির কারণে সমাজের প্রবহমান সংঘর্ষপূর্ণ চরিত্র তাঁকে বেদনাহত করত, কিন্তু তিনি তার থেকে চোখ সরিয়ে নেননি। তিনি ভুলে থাকতে চাননি সমাজের সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্ব, কিন্তু আহত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উদার বাংলাদেশের পরিবর্তনের চপেটাঘাতে। বড় সাহিত্যিক, বড় বুদ্ধিজীবী, সমাজের বড় মানুষদের অভিভাবক হিসেবে তিনি উঁচুতলার মানুষ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সমাজের নিচের ধাপের, ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর কথা বলতে ভোলেননি কখনো।
বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে বড় রায় নিয়ে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কাজ হাতে নিলে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সারা দেশে আক্রমণ করে। তারা মানুষ হত্যা করে, পুলিশ হত্যা করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা শুরু করে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়িতে আগুন লাগাতে থাকে। সেই সময়টা হঠাৎ করেই যেন মনে হয় ধর্ম নিয়ে আবার আমরা সন্ত্রস্ত, মৌলবাদীদের আস্ফালন সর্বত্র, মানুষ বিপন্ন। সত্তর বছরের বেশি বয়সের এই মানুষটা তখনো সাহস করে বারবার ধর্মান্ধতার বিপক্ষে বলেছেন।
হয়তো অনেকেই, বিশেষ করে ‘হঠকারী’ বামেরা বলবেন, তিনি দরিদ্র, অবদমিত, ক্ষমতাবৃত্তের বহু দূরে থাকা নিষ্পেষিত জনতার পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর নিয়ে নামেননি কখনো। তাঁর মৃত্যুর পর চরম দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থীদের এ রকম কিছু আক্রমণও দেখছি সামাজিক মাধ্যমে। কিন্তু আমরা বলব, তিনি তাঁর জায়গায় যা থাকার কথা সেটাই ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, সামাজিক উদারবাদী, পরিবেশবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী। তিনি ভাবনার সমৃদ্ধিতে, চিন্তার ঐশ্বর্যে, উদ্দীপনার কৌলীন্যে অন্য সবার চেয়ে আলাদাই ছিলেন, খুদে বাম বুদ্ধিজীবী ছিলেন না।
লেখক : সাংবাদিক