এক বড় জিজ্ঞাসা : নগর সরকার কেন হয় না?

ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পিছিয়ে চলে গেছে ১ ফেব্রুয়ারি। এর কারণে এসএসসি পরীক্ষাও পিছিয়েছে। এখন সবার চাওয়া নির্বাচনটি ভালো হোক।
কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মেয়র, কাউন্সিলর এলেও তারা নাগরিকদের সেবা কতটা দিতে পারবেন, সে নিয়ে আলোচনাও বাড়ছে নাগরিক সমাজে। দুজন রাজধানীর মেয়র আসবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এমন, এই মহানগরীর মেয়রদের হাতে ক্ষমতা কতটুকু আছে যে তাঁরা বা তাঁদের পরিষদ কাজ করতে পারবেন?
ঢাকা শহর মানেই ব্যাপক অব্যবস্থাপনা ও অপরিচ্ছন্নতা। বাধ্য হয়ে কিছু কিছু এলাকায়, যেমন বনানী, গুলশান ও বারিধারায় স্থানীয় মানুষ নিজেরাই সোসাইটি করে ব্যবস্থাপনার কাজ করছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ড্রেনেজ সিস্টেম, পার্ক ও জলাশয় ব্যবস্থাপনা, এমনকি যান চলাচল সবকিছুই দক্ষতার সঙ্গে করছে সোসাইটিগুলো। সিটি করপোরেশন যেখানে ব্যর্থ, তারা সেখানে সফল।
একটি সিটি করপোরেশনের জন্য এই মেগাসিটির ব্যবস্থাপনা বেশি চ্যালেঞ্জিং—এমন বিবেচনায় ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। কিন্তু এরপরও দুই সিটি করপোরেশন তাদের আওতাধীন এলাকাগুলোয় কোনো সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। এই তিনটি এলাকা ও মন্ত্রিপাড়া বাদ দিলে সারা শহরেই চোখে পড়ে আবর্জনার স্তূপ, রাস্তাঘাটের বেহাল দশা এবং খোলা নর্দমা।
তিনটি দৃশ্যমান কাজ আছে সিটি করপোরেশনের। এগুলো হলো সড়কে বাতি লাগানো, আবর্জনা পরিষ্কার করা এবং মশক নিধন করা। আর সব কাজের জন্য তাকে সরকারের দ্বারস্থ হতে হয়। বাতি লাগাবে করপোরেশন, কিন্তু বিদ্যুতের মালিক বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। সিটি করপোরেশন ফুটপাত বানাবে, কিন্তু সেই ফুটপাতে যদি একটি বিদ্যুতের খাম্বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তবে মেয়র সেটি সরাতে পারেন না। করপোরেশনকে বিদ্যুৎ বিভাগের করুণাপ্রার্থী হতে হয়। এই শহরের সব রাস্তার মালিক সিটি করপোরেশন; কিন্তু এই রাস্তায় যে যানবাহন চলে, তাকে শৃঙ্খলায় আনার ক্ষমতা নেই মেয়রের। কোনো যানবাহনের চালক বা মালিক অন্যায় করলে, সিটি করপোরেশন সরাসরি কোনো ব্যবস্থাপনা নিতে পারে না। সেই গাড়িচালকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে না, গাড়ির রুট পারমিট বাতিল করতে পারে না। এ কাজ করতে পারে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন বিআরটিএ এবং প্রায়োগিক দিক থেকে ট্রাফিক পুলিশ।
আমাদের এই মহানগরের চারপাশের নদীগুলো দখলে দখলে আজ বিলুপ্তির পথে। দখল উচ্ছেদের ক্ষমতা নেই সিটি করপোরেশনের হাতে। যারা রাস্তা দীর্ঘ সময় খোঁড়াখুঁড়ি করছে, উন্নয়নের কাজ করার নামে অর্ধ বা অসমাপ্ত করে ফেলে রাখছে, এই নগরীর মানুষের হয়ে, তার ভোটারদের পক্ষ নিয়ে সেইসব কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারছেন না কোনো মেয়র।
পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের কাজ করার জন্য ওয়াসা নামের প্রতিষ্ঠানটিকে কেন সিটি করপোরেশনের অধীনে ন্যস্ত করা যাবে না, সেটা নগরবাসীর বোধগম্য হয় না। তেমনি বোধগম্য নয়, নগর পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনের হলেও কেন পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজউক নামে একটি আলাদাভাবে সংস্থা সে কাজ করে।
বলা হয়, ৫৪টি সংস্থার দয়ার ওপর নির্ভর করে কাজ করতে হয় সিটি করপোরেশনকে। ফলে তাকে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। তাই প্রয়োজন এখন নগর সরকারের। সেটি কেন হয় না, সে এক বড় জিজ্ঞাসা।
তবুও যত দিন না হচ্ছে নগর সরকার, তত দিন থাকতে হবে বর্তমান পদ্ধতিতেই। তাই মানুষ এমন মেয়র চায়, যার নগরবাসীর প্রতি দায়িত্বানুভূতি থাকবে, যিনি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন, যেকোনো সমস্যা সমাধানে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যার থাকবে, যিনি সৎ এবং সাহসী ভূমিকা পালন করতে পারবেন। আসলে মেয়রের ক্ষমতা জনগণের রায়, সেটি মাথায় রেখেই চলতে হবে তাকে।
ক্ষমতা সীমিত হলেও মানুষের জন্য যে কিছু করা যায়, সেটি দেখিয়ে গেছেন ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পরিকল্পনা করে, মেধা, সততা আর দৃঢ়তার সঙ্গে এমন কিছু কাজ করেছেন, যা অতীতের কোনো মেয়র কখনো করতে পারেননি। তিনি দৃষ্টি দূষণ কমাতে অত্যন্ত শক্তিশালী কিছু প্রতিষ্ঠানেরও বিলবোর্ড, পোস্টার সরাতে পেরেছিলেন। রাস্তা সম্প্রসারণ করতে গিয়ে অনেক অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে দিয়েছেন। তাই একটা প্রত্যাশা এখন তৈরি হয়েছে, সেই ব্যক্তিরই মেয়র হওয়া উচিত, যিনি নগর ভবনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কঠোর, নাগরিক সংকট দূরীকরণে আন্তরিক, নাগরিক সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারবেন এবং একটি পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে যিনি কাজ করবেন পুরোপুরি অঙ্গীকার নিয়ে।
প্রতিটি সিটি করপোরেশনের অধীনে যে ওয়ার্ড কাউন্সিলগুলো রয়েছে, সেগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। মেয়ররা ওয়ার্ডগুলোর জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ করতে উদ্যোগ নিতে পারেন। কারণ, জনগণকে সম্পৃক্ত করে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার কাজটি করতে পারেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররাই। মেয়রকে ক্ষমতার কেন্দ্র না বানিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করাই সেবা পরিষেবা সম্প্রসারিত করার বড় পথ।
সমস্যা হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন মেয়র, বড় কাজ করবেন মেয়র। কিন্তু মাইক্রোলেভেলের কাজটা করতে হবে কাউন্সিলরদেরই। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা জনগণের সঙ্গে সমন্বয় করা ছাড়া একেবারেই সম্ভব নয়।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা