করোনাকালে জীবন ও জীবিকা

আর কতদিন? আর কতদিন থাকতে হবে এমন ঘরবন্দি হয়ে? ঠিক এমন একটা প্রশ্ন সবার মুখে। কিন্তু উত্তর অজানা, যেমন—অজানা-অদেখা শত্রু করোনাভাইরাস। এ সংকট ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, সমষ্টির সংকট। এ সংকট শুধু গরিবের নয়, সবার। এ সংকট শুধু শহরের নয়, সব প্রান্তের। এ রোগ শুধু বয়স্কদের আক্রান্ত করে না, কাবু করে না, সব বয়সীদেরই করে।
এমন এক বিশ্ব দুর্যোগের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই রোগ থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছে সবাই। গতকাল সোমবার বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রোগের কারণে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সেটা বলার পাশাপাশি অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন। অর্থনীতি যে বেশ খানিকটা অনিশ্চয়তার খাদে তলিয়ে যাচ্ছে, সেটা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ‘আজ দেশের সিংহভাগ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ছোটখাটো কারখানা বন্ধ। গণপরিবহন ও বিমান চলাচল স্থগিত। আমাদের আমদানি-রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বেশিরভাগ দেশে প্রবাসী ভাইবোনেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। স্থবিরতা নেমে এসেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে।’
এটাই যখন বাস্তবতা, তখন আমাদের সামগ্রিক আচরণ কেমন হবে সেটা নিয়ে ভাবনা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরের প্রধান যোদ্ধা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু যোদ্ধা আরো আছে। আছে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাঠপর্যায়ের প্রশাসন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কর্মীরা এবং অবশ্যই গণমাধ্যমকর্মী, যাঁরা নিরলসভাবে মানুষকে তথ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে, আমি নিজেও শেয়ার করেছি। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা শুভর ছবি। করোনার ভয়ে মৃত ব্যক্তির জানাজায় যখন পরিবারের কেউ আসেনি, শুভ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির গোসল করিয়েছেন, নিজের কাঁধে খাটিয়া তুলে নিয়েছেন এবং সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নিজেই জানাজা পড়িয়েছেন। এই ছবি সেই ছবির একদম বিপরীত। কোন ছবি নিশ্চয়ই মনে আছে পাঠকের। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ম্যাজিস্ট্রেট সায়েমা হাসান মাস্ক না পরায় দুই বয়স্ক নাগরিককে কানে ধরিয়ে সেই ছবি নিজের ফেসবুকে কাভার করেছিলেন।
সায়েমা নিন্দা কুড়িয়েছেন, আর বদরুদ্দোজা শুভ পাচ্ছেন অভিবাদন। নিশ্চয়ই অভিবাদন পাবেন আমাদের সেনাবাহিনী, আমাদের পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা, আমাদের বেসামরিক প্রশাসন, ব্যাংকার ও গণমাধ্যমকর্মীরা।
লকডাউন করে, ঘরে আটকে মানুষকে রোগ থেকে দূরে রাখা, করোনা সংক্রমণের ধারণা পেতে পরীক্ষা করা, আর যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যথাযথ চিকিৎসা করার বাইরেও বড় প্রশ্ন, আজ কোনটা বেশি জরুরি—জীবন না জীবিকা? জীবন বাঁচাতেই হবে। কিন্তু বাঁচতে হলে তো জীবিকারও প্রয়োজন আছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজেদের ও অন্যদের বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ আর সেটার জন্য জীবিকা চাই কত মানুষের!
মানুষকে আমরা যতই বলি না কেন ঘরে থাকুন বা স্টে হোম লিখে ফেসবুকে কাভার পেজ করি না; বাস্তবতা অনেক নির্মম। সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বের আহ্বান চাপা পড়ে যায় সামান্য বেতনের আশায় ৫০-১০০ কিলোমিটার হেঁটে আসা পোশাক শ্রমিকের দুর্দশার কাছে। পরিযায়ী এই শ্রমিকদের এই শহরে ফিরে আসা বা আবার ঘরে ফেরার ছবি আমাদের বুঝিয়ে দেয় সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বও এক শ্রেণি বিভাজন। শুধু দুঃখপ্রকাশ করে বিজিএমইএ নেতৃত্ব দায়িত্ব সেরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী কয়েক দফায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কাজটি তাঁর একার নয়। এই সংকটের সময় কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়, তার উপায় ভাবতে হবে সবাইকে। ফাইটিং স্পিরিট সৃষ্টি করতে প্রয়োজন জাতীয় চেতনার। তাই এমন পরিস্থিতিতে যখন ছয়জন চিকিৎসককে বরখাস্ত করা হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না কোথাও না কোথাও এই লড়াকুদের ভেতর একটা বিভাজনরেখা টানার চেষ্টা আছে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক ও যন্ত্র থাকতেই হবে। প্রণোদনাও লাগবে এবং প্রধানমন্ত্রী ১০০ কোটি টাকার সম্মানী ঘোষণা করেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতার জায়গাটাও নিশ্চিত করতে হবে।
সীমিত সম্পদের ওপর দাঁড়িয়ে এখন অবধি যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বাস্থ্যবিমার পদক্ষেপ ও সম্মানীর ঘোষণা অনুপ্রেরণা জোগাবে সবাইকে। বেশ ভালো বুঝতে পারছি, লকডাউন আরো কিছুদিন থাকবে। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন এলাকায় নাগরিকেরা লকডাউন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেননি। কিন্তু করতে হবেই। ব্যবস্থাপনার জায়গায় লাগবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের মানবিক মুখ। ত্রাণ আর চাল চুরিতে ব্যস্ত যেসব জনপ্রতিনিধি, তাঁরা থামুন। যদি তাঁরা না থামেন, তাহলে প্রশাসনের উচিত হবে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। আমরা বদরুদ্দোজা শুভর মতো জনসেবক চাই, তেমনি মানুষের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার জন্য ত্রাণ চোর আর চাল চোরদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কঠোর প্রশাসনও চাই।
সবাইকে এক অচেনা বৈশাখের শুভেচ্ছা।
লেখক : সাংবাদিক