ছাত্রলীগের ভারমুক্ত দুজনের কাছে চাওয়া

ভারমুক্ত হয়েছেন ছাত্রলীগের প্রধান দুজন। শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দুজনের ‘ভারমুক্তি’র ঘোষণা দেন তাদের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে কাউন্সিল ছাড়াই নিয়মিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন আল-নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী গত সেপ্টেম্বরে বরখাস্ত হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে এসেছিলেন এই দুজন।
বয়সের বিচারে খুবই তরুণ জয় ও লেখক। কিন্তু বড় দায়িত্ব। একটি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন পরিচালনার চ্যালেঞ্জগুলো তাঁরা জানেন। বিশেষ করে যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ করে তাঁরা সামনে এসেছেন, সেটাও নিশ্চয়ই তাঁরা পদে পদে মনে রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আদর্শ ছাড়া, নীতি ছাড়া, সততা ছাড়া কখনও কোনো নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে না। সেই নেতৃত্ব দেশকে কিছু দিতে পারে না। জাতিকে কিছু দিতে পারে না। মানুষের কল্যাণে কোনো কাজ করতে পারে না। কোনো ধরনেরই কোনো সফলতা দেখাতে পারে না।”
লেখক ও জয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বড় চ্যালেঞ্জ। আদর্শ, নীতি ও সততা বজায় রেখে এই সংগঠনকে সমানে এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য আমাদের ছাত্ররাজনীতির ধারাকেই বদলাতে হবে। কিন্তু আমাদের ছাত্ররাজনীতিকে বদলানো সহজ না। কারণ যা রাজনীতিই নয়, তাকে বদলানো কঠিন। সবচেয়ে প্রাচীন এই ছাত্র সংগঠন এখন নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কোন্দল নিয়েই অনেক ব্যাতিব্যস্ত থাকে। এমনকি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনও কলহের খবর এসেছে নানা জায়গা থেকে। বিরোধীদের সাথে নয়, সংঘর্ষ চলে নিজ দলেরই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে। ক্যাম্পাসে, অক্যাম্পাসে, বৃহত্তর পরিসরে আধিপত্যের লড়াই-সংঘাতের খবর নিয়মিত আসে গণমাধ্যমে। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ডাকসু সহ-সভাপতি নূরের ওপর হামলাও বলে দেয় সংগঠনের ভেতরে শৃঙ্খলা সমস্যা আছে।
দলীয় সাংগঠনিক রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক রংহীন ছাত্র রাজনীতি করা যায় না। ছাত্ররাজনীতি হতে দলীয় রাজনীতি সরে দাঁড়ালে টাকার খেলা কমবে, কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার লড়াই কমবে। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেভাবে ক্যাম্পাস রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছে তাতে সবাই বলাবলি করছে যে, ক্যাম্পাস রাজনীতির এতখানি গুণগত অধঃপতন এদেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। নিম্নগামিতার সাধনা শুরু হয়েছে যেন। কোনো কোনো শিক্ষক পর্যন্ত অভূতপূর্ব সব কদর্যতা প্রদর্শন করে চলেছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হোক বা সরকারি কলেজ বা ইনস্টিটিউট হোক, যেখানে যেখানে ছাত্ররাজনীতি আছে, সেখানেই সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে, হিংসাত্মক হানাহানি চলছে, শিক্ষার্থীরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি শিক্ষক-অধ্যাপকরাও আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কোথাও কোথাও।
এসব কারণেই প্রশ্ন উঠছে এই ছাত্ররাজনীতি কোন রাজনীতি? এই রাজনীতিতে ছাত্রদের কোন কল্যাণ হয়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বা কোন উন্নতির শিখরে পৌঁছে?
এমন বাস্তবতায়, বুয়েটে আবরার খুনের পর দেশের শিক্ষাঙ্গনের এই পরিস্থিতি বহু চর্চিত একটি প্রশ্নকে আবার খুব বড় করে তুলে ধরছে—ছাত্ররাজনীতির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ? ছাত্রদের কি রাজনীতি করার অধিকার আদৌ থাকা উচিত? এই প্রশ্ন যেমন বহুবার তোলা হয়েছে, তেমনই বহুবার এর উত্তরও দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস বদলে দেওয়া নানা আলোড়ন ছাত্রদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে নানা সময়ে। কিন্তু আজ ছাত্রদের রাজনীতি করার প্রবণতায় ভালো কর্ম চেখে পড়ে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নামে যা চলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা আসলে তাণ্ডব, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা।
এখান থেকে ক্যাম্পাসসমূহকে বের করার বড় দায়িত্ব আসলে সরকার, ক্ষমতাসীন দল এবং সরকারদলীয় ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের ওপর। ছাত্ররাজনীতি, কতটা দলতন্ত্রের পালিত ছাত্ররাজনীতি হবে আর কতটা ছাত্রকল্যাণের রাজনীতি হবে, সেই ভাবনাটা ছাত্রলীগের এই তরুণ নেতৃত্ব ভেবে দেখবেন বলে আশা করি।
এটাই বিবেচনার দাবি রাখে। সেই বিবেচনা গভীর বিবেচনা। দীর্ঘ ২৯ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন কবে হবে কেউ জানে না। ডাকসু প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকর হতে পারেনি। সেখানে কার কতটুকু দায় আছে, সেটা সবার জানা। বড় কারণ ক্যাম্পাসে সেই পরিবেশটাই সৃষ্টি করা যায়নি যে ছাত্র সংসদ ছাত্রদের হয়ে কাজ করবে।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। তার প্রতি এই কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী পড়ুয়াদের যে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেখা গেল, তা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবায়। কেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতিকে এতটা ঘৃণা করে? তবে কি অদূর ভবিষ্যতে দাবি উঠবে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনও একদিন অরাজনৈতিকভাবে হবে? আসলে অরাজনীতি বলে তো কিছু নেই, কিন্তু সুস্থ মানুষের প্রত্যাশা ছাত্ররাজনীতিকে দলীয় রাজনীতিতন্ত্র হতে মুক্ত করতে হবে। অভিভাবকরা মনে করেন, তাদের সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যা পড়ছে, সেখানে তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। পড়বার সময় তাদের নানাবিধ সমস্যা, বিভিন্ন পরামর্শ ইত্যাদিও থাকা সম্ভব। তার জন্য রাজনৈতিক দল বা তাদের অনুসারী সংগঠনের দ্বারস্থ হতে হবে কেন? তারা এটাও মনে করেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় সে প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক, সুতরাং প্রতিষ্ঠানের বাইরে তার নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস, এমনকি রাজনৈতিক পরিচয়ও থাকতেই পারে। সেই বিশ্বাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক রাজনীতির জটিলতায় আসল জাতীয় রাজনীতি থেকে তারুণ্য দূরে থেকে যাচ্ছে বারবার। ক্যাম্পাসে ভালো ও সুস্থ রাজনীতি না থাকলে তারুণ্য আসলে জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে যাবে—এটা যেন বুঝতে পারেন জয় আর লেখক, সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা